এম এ কাদের: সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকার যে রাজস্ব আহরণ করে, তার প্রায় ৩৫ শতাংশ আসে আয়কর থেকে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট বাজেট ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৪ হাজার ৯৮১ কোটি টাকাই আয়কর খাত থেকে আসবে বলে নির্ধারণ করা ছিল। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, একজন নাগরিকের কর্মজীবন শুরু হলে পুরুষের বার্ষিক আয় ৩ লাখ, নারী ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৩ লাখ ৫০ হাজার এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৫০ হাজার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হলে ওই নাগরিক আয়করের আওতায় আসবেন। করমুক্ত আয়সীমার পর প্রথম ১ লাখ টাকা আয় পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকায় ২০ শতাংশ এবং এর পরে অবশিষ্ট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়ার বিধান করা ছিল। এই নিয়মে শিথিলযোগ্য আয়ের পরে পরবর্তী ১ লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ হারে ৫ হাজার টাকা, পরবর্তী ৩ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ হারে ৬০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ হারে ১ লাখ টাকা। এ হিসাবে কারও বার্ষিক আয় ১৬ লাখ টাকা হলে তাকে আয়কর দিতে হবে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর ওপরে যদি কারও আয় আর মাত্র ৪ লাখ টাকা, অর্থাৎ মোট বার্ষিক আয় ২০ লাখ টাকা হলে আয়কর দিতে হবে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।
করের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বছরে ৫০ লাখ টাকা আয় দেখালে তাকে কর দিতে হবে গড় প্রায় ২১ শতাংশ হারে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কোম্পানি ক্ষেত্রে এই হার এর চেয়ে অনেক বেশি। ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আয়ের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সিগারেট, বিড়ি জর্দা, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি ও মোবাইল ফোন অপারেটরের ক্ষেত্রে উক্ত আয়ের ৪৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা থাকলেও বাস্তবে অনেকেই এ নিয়ম মেনে চলে না। এই অধিক হারে আয়কর দেয়ার নিয়মের কারনেই করদাতারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে আয়কর একেবারেই কম দিচ্ছে এবং বৈধপথে উপার্জন হওয়া সত্তে¡ ও অপ্রদর্শনের কারণে এ অর্থ বৈধতা হারাচ্ছে। এ সুযোগে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী-সুবিধাবাদী, ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। তাছাড়া আবাসিক বাড়ি বা এপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক রাজাধানীর ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় প্রতি বর্গমিটার ৬ হাজার টাকা, সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০০ বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং জেলা সদরের পৌর এলাকার ২০০ বর্গমিটারের অধিক আয়তনবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। সড়কপথে বাস এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে ধারণক্ষমতা ও মডেল ভেদে বছরে ৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে ১৫০০ সিসি কার ও জিপের জন্য ২৫ হাজার, ২০০০ সিসি পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩৫০০ সিসি থেকে যত ওপরেই হোক ২ লাখ টাকা নির্ধারণ আছে। এছাড়া প্রতিটি মাইক্রোবাসের জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাগরিক তার কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর, ঢাকা সিটি করপোরেশনের জন্য ৫ হাজার, অন্যান্য সিটি করপোরেশনের জন্য ৪ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে নথিভুক্ত হতে পারেন। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকার জন্য ৩ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে শুরু করলে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা তার আয়কর নথিতে সাদা টাকা হিসাবে মূলধন দেখানো নিয়ম আছে। এ ছাড়া ওই নথিতে পৈতৃক সম্পত্তি যোগ হতে পারে। এরপর তার কর্মজীবনের সব আয়ের ওপর নির্ধারিত কর পরিশোধের মাধ্যমে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ও মূলধন বাড়ার কথা থাকলেও করদাতার আয়কর নথির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার তেমন মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশে লাখ লাখ যানবাহন (বাস-ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি, জিপ, মাইক্রোবাস) এবং একই ব্যক্তির একাধিক গাড়ি থাকা সত্তে¡ও অনেকের আয়কর নথিতে মূলধন হিসেবে কমমূল্যের এক-দুটি গাড়ি দেখানো আছে। গাড়ির প্রকৃত সংখ্যা বা মূল্য মূলধনে দেখানো হয় না।
একজন নাগরিকের বাড়ি, গাড়ি, জায়গা, জমি, সম্পদের মূল্য ৫ কোটি টাকা হলেও তার আয়কর নথিতে হিসাব দেখানো আছে হয়তো ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা, যা প্রকৃত হিসাবের ১৫ শতাংশরও কম। এতে সরকার করদাতার কাছ থেকে আয়কর হারাচ্ছে, অন্য দিকে অধিক কর নির্ধারণ করায় করদাতা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে কর দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর বৈধ পথে আয় করা অপ্রদর্শিত টাকা, অধিক হারে আয়কর নির্ধারণের কারণে সাদা টাকা হিসাবে বৈধতা না পাওয়ায়, দেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে আয় করা কালো টাকাও অধিকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে।
একটি উপজেলা শহরে পৌর এলাকাধীন এক তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত ব্যবসায়িক এবং আবাসিক ভবনের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০টি। একেকটি ভবনের মূল্য আনুমানিক জমিসহ ১ কোটি টাকার অনেক ঊর্ধ্বে। উল্লেখিত ভবনের মূল্য আয়কর নথিতে মূলধন হিসেবে মাত্র ১ কোটি টাকা দেখালে শতকরা ২ শতাংশ হারে আয়কর ধরা হলেও তাকে ওই ভবনটির জন্য দুই লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। শুধু উপজেলা শহরেও ৩০০ ভবনের মধ্যে ১০০ ভবনও আয়কর দাতার নথিতে দেখানো নেই। উপজেলা শহরে শুধু ৩০০ বাড়ির সর্বনি¤œ ২ শতাংশ হারে সরকারকে আয়কর দিলে প্রতি উপজেলায় অতিরিক্ত প্রায় ৬ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হবে। একই নিয়মে প্রতি জেলা শহরে কমপক্ষে ১০ গুণ হারে আয় হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। তাহলে ৬৪ জেলায় রাজস্ব আয় হবে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। পুরোনো জেলা শহরে এর ১০ গুণ বেশি টাকা কর আদায় হবে। বিভাগীয় শহরে ভবনের সংখ্যা জেলা শহর থেকে অন্তত ১০ গুণ বেশি। তাহলে কর আদায় হবে হাজার হাজার কোটি টাকা।
রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোয় লাখ লাখ বাণিজ্যিক ও আবাসিক বাড়ির মূল্যকে মূলধন হিসেবে সর্বনি¤œ হারেও আয়কর নির্ধারণ করে আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি করলে সরকারের আয় হবে হাজার হাজার গুণ বেশি অর্থাৎ লাখ লাখ কোটি টাকা। দেশের উপার্জনক্ষম (কর্মজীবনে) ব্যক্তির জন্য আয়কর নথি একটি আয়না স্বরূপ। প্রত্যেকের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করলে, ওই ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা আয়নাস্বরূপ বোঝার দরকার ছিল। বর্তমানে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা শুরু হওয়ায় সাধারণ ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের লাভের হার অত্যন্ত কম। তাছাড়া অনেকের বার্ষিক আয় থেকে খরচও অনেক বেশি। করদাতার কাছে করের হার অত্যন্ত বেশি হওয়ার কারণে সে কর দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ও বিক্রয়ের ওপরে অধিক হারে ভ্যাট নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অনেক করদাতার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, সরকার সর্বনি¤œ হারে কর দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলে, তারা বৈধপথে অপ্রদর্শিত আয়ের আয়কর দিয়ে সব স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার প্রদর্শন করে দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে চায়। সরকার স্বল্প হারে কর নির্ধারণ করলে আয় প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বৈধ পথে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করার সুযোগ পেলে দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে বন্ধ হবে। তাছাড়া করদাতা স্বেচ্ছায় কর দিলে পরামর্শদাতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বন্ধ হবে এবং সবাই স্বেচ্ছায় কর দিতে উৎসাহিত হবে।
দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজস্ব আদায়ের বিকল্প নেই। কাজেই বর্তমান হার থেকে করের হার শিথিল করে সর্বনি¤œ হারে অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করলে বৈধ পথে উপার্জিত অপ্রদর্শিত সম্পদ, টাকা-পয়সা ধারাবাহিক প্রমাণ সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদর্শন করার সুযোগ দিলে সরকারের আয় যেমনি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে তেমনি অপ্রদির্শত আয় প্রদর্শনে বৈধতা পাবে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এতে করে করদাতা প্রতি বছরই নিজ ইচ্ছায় তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। এছাড়া সহজ শর্তে সর্বনি¤œ কর কমিয়ে আনলে নতুন করদাতার সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ৪৫ শতাংশের জায়গায় ১০০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা যেতে পারে।
অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, অবৈধ পথে আয়, ধারাবাহিকতা না থাকা, আয়ের উৎস না থাকা, অধিক হারে অপ্রত্যাশিত আয় দেখানো বা ইতঃপূর্বে আয়কর নথি না থাকা, এদের এ সুযোগের আওতায় আনা যাবে না। দুর্নীতিবাজরা এ সুযোগের আওতায় এলে অতি উৎসাহিত হয়ে কালোটাকা, সাদা করার সুযোগ নিতে পারে। প্রায় প্রতি অর্থবছরেই অধিক কর নির্ধারণ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া সাধারণ জনগণ এ সুযোগ নিতে পারে না। সহজ ও সর্বনি¤œ কর নির্ধারণের বিষয়টি অভিজ্ঞজনের বিচার বিশ্লেষণে এনে, জটিলতা এড়িয়ে স্বচ্ছ আইনের মাধ্যমে কর নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি হলে, দেশের সচেতন সুনাগরিক নিজ ইচ্ছায় প্রতি বছর তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দিতে উৎসাহিত হবে। ফলে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রবৃদ্ধিও অনেক হারে বৃদ্ধি পাবে। অধিক হারে সরকারের উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলে, উন্নত বিশ্বের মতো দ্রæত দেশের উন্নয়ন সহজ হবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন দেশকে উন্নত রাষ্টে পরিণত করা ২০৪১ সাল নয়, এর আগেই বাংলাদেশ বিশ্বের একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে ধারণা করা যায়।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনিভার্সেল পোলট্রি হ্যাচারি লি.