বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে কয়েক লাখ মানুষ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের হালিশহর, পতেঙ্গা ও কাট্টলী এলাকায় ১৩টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর কার্যক্রম আছে। এর মধ্যে কেএনটি, ইস্টার্ন লজিস্টিকস ও ওশান কনটেইনার নামের তিনটি বেসরকারি ডিপোয় রপ্তানির জন্য শতাধিক কনটেইনারে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ অনুমোদনবিহীন পেট্রল পাম্পও রয়েছে। কনটেইনার ডিপোগুলোর পাশে ১০ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। গত ৪ জুন রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনার পর এসব ডিপোয় কর্মরতসহ স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগভাবে দিন পার করছেন।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারিত ইয়ার্ড সুবিধার অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চট্টগ্রামের মোট ১৯টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো পরিচালনার অনুমোদন দেয়। এসব কনটেইনার ডিপো শতভাগ রপ্তানি পণ্য ও ৩৭ রকমের আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনারাইজড কার্গো থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে। তারা গড়ে প্রায় ১৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। এর মধ্যে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিএম কনটেইনার ডিপোয় আগুনের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৯ জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। এ দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন মহলে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে বড় রকমের সংকট ও উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পাশাপাশি এ দুর্ঘটনার পর সিঙ্গাপুর পোর্টে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান সীমিত করায় বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রামের পোর্টলিংক, কেএনটি, ইস্টার্ন লজিস্টিকস ও ওশান কনটেইনার নামের চারটি বেসরকারি ডিপো। রপ্তানির জন্য এসব ডিপোয় আটকা পড়েছে ১০৫ কনটেইনার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। প্রতি কনটেইনারে ১২ টন করে হিসাব করলে এসব কনটেইনারে রয়েছে ১ হাজার ২৬০ টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। এসব রাসায়নিক পদার্থ থাকায় ডিপোয় কর্মরতরাসহ আশপাশে বসবাসকারী ১০ থেকে ১৫ লাখ স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি দল গত ১১ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামের সব ইয়ার্ড পরিদর্শন করে। তারা জানান, সীতাকুণ্ডের ছয়টি কনটেইনার ডিপোর তিনটিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট (অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহƒত বিশেষ পানিকল) ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। ছয়টি কনটেইনার ডিপোর মধ্যে শুধু পোর্ট লিংক কনটেইনার ডিপোয় রাসায়নিকের কনটেইনার রাখার তথ্য পেয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক দল। সেখানে কনটেইনারগুলো অপরিকল্পিতভাবে রাখা আছে। সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ডিপো ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিকে ভর্তি কনটেইনারগুলোকে অন্যান্য কনটেইনার থেকে আলাদা রাখার জন্য বলেছে ফায়ার সার্ভিস টিম। এজন্য দেয়াল নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের একটি চিঠি দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুুক একাধিক ডিপোর সিনিয়র কর্মকর্তারা বলেন, বিএম ডিপোর মতো আরও চারটি কনটেইনার ডিপোয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আছে। এসব রাসায়নিক পদার্থের রপ্তানি নিয়ে চিন্তায় আছি। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর পোর্ট রাসায়নিক রপ্তানি কঠোর করেছে। অথচ এসব রাসায়নিক রাখার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই, যা নিয়ে কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, কল-কারখানা ও শিল্প পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সব সংস্থা নীরব রয়েছে। তাদের কারণে আমাদের জীবনও হুমকিতে। এছাড়া ডিপোয় এখন কনটেইনার চাপে আছি। সব মিলিয়ে মানসিক অবস্থা ভালো নেই। ভয়ে ভয়ে কাজ করতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, বিএম ডিপোর আশপাশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নেই কিন্তু নগরীর পতেঙ্গা, বন্দর, কাট্টলীসহ অন্যান্য এলাকায় গড়ে ওঠা আইসিডিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। বিএম ডিপোর মতো কিংবা এর চেয়ে আরও কম শক্তিশালী দুর্ঘটনা নিমিষেই সেখানে লাখো মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডই শহরের ভেতর অবস্থিত কনটেইনার ইয়ার্ডগুলোকে শহরের বাইরে সরিয়ে নেয়ার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বন্দরের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বারবার এসব কনটেইনার ইয়ার্ড বন্দরের ২০ কিলোমিটার দূরত্বের বাইরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কিন্তু অজানা অদৃশ্য কারণে সিদ্ধান্তগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না। মানুষের জীবনের চেয়ে কি তাহলে ব্যবসা অনেক গুরুত্বপূর্ণ? তিনি আরও বলেন, এমন একটি দুর্ঘটনা যদি আবাসিক এলাকায় নির্মিত কনটেইনার ইয়ার্ডগুলোয় হয়, তাহলে কী পরিমাণ হতাহত এবং মানবিক বিপর্যয় হতে পারে, সেদিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকায় ফায়ার সার্ভিস কীভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং হতাহতদের হাসপাতালে আনা-নেয়া করবে সে প্রশ্ন আজ সবার মুখে মুখে। তাই আর অবহেলা নয়, এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে শক্ত হাতে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো (অফডক) মালিকদের সংগঠন বিকডার সচিব রুহুল আমিন বলেন, বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর নিরাপত্তা সংকটে নেই। বিএম ডিপোর ঘটনাটা ছিল একটি দুর্ঘটনা। আর একটি ডিপো তো রাতারাতি তৈরি হয় না। এটি বন্ধ থাকলে সব ডিপোর ওপর চাপ পড়বে। আর এ মুহূর্তে চাপ নেয়ার মতো ডিপোগুলোর পরিস্থিতি নেই। এতে দেশের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সেøা হবে। তিনি আরও বলেন, অন্য যে চারটি ডিপোয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রয়েছে, সেগুলো দ্রুত শিপমেন্ট বা কারখানায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুর পোর্ট দিয়ে এসব কনটেইনার পাঠানো না গেলে পোর্ট কেলাং বা অন্য বন্দর দিয়ে পাঠানোর সুযোগ আছে কি না দেখতে হবে। তা সম্ভব না হলে এসব কনটেইনার নিজ নিজ কারখানায় নিয়ে যেতে বলা হতে পারে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরে গত বছর মোট ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।