নিরাপদ মাতৃত্ব: করোনাকাল ও সচেতনতা

মো. আব্দুল আলীম: ভালোবেসে নিজের পছন্দে রায়হানকে বিয়ে করেন রিনা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। শুরু থেকেই শ্বশুরবাড়িতে নানা অবহেলায় দিন কাটছিল রিনার। স্বামী রায়হান বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। পরিবারে বাবা-মায়ের ওপর কথা বলার সাহস নেই তার। বিয়ের প্রথম বছরেই গর্ভবতী হন রিনা। গর্ভাবস্থায় শ্বশুর-শাশুড়ি রিনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে নিরুৎসাহিত করলেও রায়হান তাকে দু’বার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছেন। প্রসববেদনা শুরু হলে শাশুড়ি গ্রামের দাইয়ের সাহায্যে সন্তান প্রসব করানোর চেষ্টা করেন। রাতভর চেষ্টায় ব্যর্থ হলে নিরুপায় হয়ে রায়হান তাকে স্থানীয় থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে মৃত পুত্রসন্তানের জন্ম দেন রিনা। অজ্ঞতা আর সচেতনতার অভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রিনা রক্ষা পেলেও সময়মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিলে তার এত বড় ক্ষতি হতো না; সন্তানহারা হতে হতো না রিনাকে।

নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি মায়ের অধিকার। সুস্থ-সবল শিশু দেশের অমূল্য সম্পদ। মায়ের গর্ভকালীন সুস্থতাই পারে একটি সুস্থ শিশু জন্ম দিতে। আর এ জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব অপরিহার্য। গর্ভবতী মায়ের যে কোনো সময় জটিলতা দেখা দিতে পারে এ ব্যাপারটি পরিবারের সবার জানা উচিত এবং এ ব্যাপারে সচেতন থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো মা শত যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ মাস শিশুটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে পৃথিবীর মুখ দেখায়। কিন্তু জন্ম দানের ক্ষেত্রে আমরা মায়েদের কতটা নিরাপদ রাখতে পারছি, সেটা ভাবার বিষয়। মা হওয়ার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি বা সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, তা অনেকেরই জানা নেই। অসচেতন মা ও তার পরিবারের সদস্যদের কারণেই মায়েরা মাতৃত্বকালীন নানা জটিলতায় ভোগে। মা ও শিশুস্বাস্থ্যের ওপরই সুস্থ জাতি গড়ে ওঠা নির্ভর করে। জাতিসংঘ প্রণীত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে যে আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছে, তার তিনটিতেই মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে।

‘মা’ ডাকটি খুব ছোট, কিন্তু মধুর। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম এই ডাকটি শোনার জন্য অনাগত সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মা মৃত্যুবরণ করছেন। অথচ একটু সচেতনতাই পারে এসব মাকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে। অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অসচেতনতার কারণে বহু মা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। শিশুমৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে প্রসূতি মা। তবে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে বর্তমানে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার উভয়ই কমেছে। ২০১৭ সালে গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ জন থাকলেও বর্তমানে তা ১৭২ জনে নেমে এসেছে। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুহার ২০ জন থাকলেও বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১৮ দশমিক চার ভাগে উন্নীত হয়েছে।

১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ মে দিনটিকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেন। এর পর থেকে প্রতিবছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছর সম্পূর্ণ আলাদা এবং ভিন্ন আবহে দিনটি পালিত হয়েছে। করোনাযুদ্ধে সবাই দিশাহারা। ডাক্তাররা জীবন বাজি রেখে করোনা-আক্রান্তদের দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনই প্রেক্ষাপটে পালিত হয়েছে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস, ২০২০’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ‘করোনাকালে ঘরে থাকি, মা ও শিশুকে নিরাপদ রাখি।’

বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এখনও অন্তরায় বাল্যবিয়ে, যদিও বাল্যবিয়ের হার অনেক কমেছে। ১৮ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের হার ২০১৫ সালের ৬৬ শতাংশের তুলনায় বর্তমানে ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বাল্যবিয়ে ও কিশোরী বয়সে মাতৃত্ব দুটোই কোনো মেয়ের জন্য অনেক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অল্প বয়সে গর্ভধারণ মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সরকার। সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণের মাধ্যমে কৈশোরকালীন মাতৃত্ব রোধ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২০ বছরের আগে সন্তান ধারণ নয় এ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে সচেতন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাদানের পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম এবং নরমাল ডেলিভারি হওয়ার পর প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সন্তান জš§ দেওয়ার পর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করলে ঘনঘন সন্তানধারণের বিষয়টি এড়ানো সম্ভব। এতে মা ও সন্তান দুজনেরই স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। উপরন্তু মাঠকর্মীদের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে সাধারণ ডেলিভারি বা প্রসবের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের কার্যক্রম জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। কন্যাশিশুর শিক্ষার সুযোগ আরও বাড়বে, বাল্যবিয়ে রোধ হবে এবং তারা সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি হবে।

দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসব-পরবর্তী সময়ে, যাদের ৫৬ ভাগই মারা যায় প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এসব মাতৃমৃত্যুর ৩১ শতাংশই ঘটে রক্তক্ষরণের কারণে। ২৪ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী খিঁচুনি বা একলাম্পশিয়া। এছাড়া তিন শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটে বাধাগ্রস্ত অবস্থা বা প্রসবব্যথার কারণে। মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৩ ভাগই ঘটে থাকে বাড়িতে প্রসবের কারণে। সরকার মাতৃ ও শিশুমৃত্যুরোধে সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে নারীর গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর জরুরি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা দেখা দিলে দ্রুততার সঙ্গে যাতে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। এখান থেকে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পাচ্ছে রোগীরা। জনগণের দোরগোড়ায় কমিউনিটি ক্লিনিক হওয়ায় শিশুদের টিকা ও ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে আগের মতো দূরে যেতে হয় না। ফলে জরুরি অবস্থা ছাড়াও নানা কারণে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে গর্ভাবস্থায় নারী, শিশু ও প্রবীণরা। বর্তমানে এ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রায় ৮২ শতাংশ স্থানীয় জনগণ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। এটা স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বড় সফলতা।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর মেয়াদি চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রমসহ মা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের ছয় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ, ভাউচার স্কিম ও তিন বছর মেয়াদি মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করা হয়েছে। নবজাতকের সুরক্ষায় ‘জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কর্মসূচি’ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। দেশে মাতৃমৃত্যু, নবজাতক ও শিশুমৃত্যু ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ৭০-এর নিচে এবং নবজাত মৃত্যুহার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ১২-তে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি (২০১৭-২২) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং এরই মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্র (২০১৯-৩০) অনুমোদিত হয়েছে এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ কর্মসূচিটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হলে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র স্বাস্থ্যবিষয়ক সূচকগুলো অর্জনে এ উন্নয়ন কর্মসূচি বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, ১০৭টি মেডিকেল কলেজ, পাঁচ হাজার ১৮২টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, প্রায় ১০ হাজার ৪০০ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৪৬টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতাল, ৪২৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাঁচ লক্ষাধিক স্বাস্থ্যসেবাদানকারী কর্র্র্র্র্র্র্মী দেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত, যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি মজবুত ও টেকসই কাঠামোর ওপর দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছে। বর্তমান সরকারের এ সাফল্যকে টেকসই করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজনÑপ্রয়োজন সচেতন হয়ে নিজেকে ও অপরকে সাহায্য করা।

পিআইডি নিবন্ধ