নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে?

এম. আবুল ফয়েজ মামুন : গণতন্ত্রে ভোট বা নির্বাচন মানে উৎসব। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভোটের উৎসব হারিয়ে গেছে। এখন কোনো ভোটেই আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি দেখা যায় না। ভোটের রাজনীতির চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ থেকে হচ্ছে বিবর্ণতর। ভোট ব্যবস্থায় পরপর দুটি বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী হওয়ার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা বিরাজ করছিল, সেসব বিষয়ের নিরসনে চ্যালেঞ্জে নেমেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটার ও প্রার্থীদের আস্থা অর্জন করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সর্বজনগ্রহণযোগ্য করার প্রত্যয় ইসির। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে এই ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কিনা এবং সকল বিতর্ক এড়িয়ে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সবার মতামতের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। তাই রাজনৈতিক ‘দ্বন্দ্ব’ সামলে সব দলকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন নির্বাচন কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণ নিজের ভোট নিজে দিতে পারাকে এক ধরনের অধিকার আদায় বলে বোধ করতেন। সারা বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার একটি প্রতিশোধ হিসেবে নির্বাচনকে বেছে নিতেন। নির্বাচনের পর তাদের সব মুশকিলের আসান হতো না বটে, তবে তারা আরেকটি নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকতেন। রাজনীতিকরাও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা বলে ভোট চাইতেন। রক্তের বিনিময়ে হোক কিংবা যুদ্ধের বিনিময়ে, রাষ্ট্র ও সরকার কীভাবে কার দ্বারা পরিচালিত হবেÑএ বিষয়ে বাংলার জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত ছিল। সেই মতামতের গুরুত্বকে উপলব্ধি করেই নির্বাচনী ব্যবস্থা। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রকাশ করেন ভোটের মাধ্যমে। তার পরের তিনটি নির্বাচন একতরফার দোষে দুষ্ট। দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের পর বলা যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জনগণের মাঝে আবারও উৎসাহ ফিরে আসে। সে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে এই উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ দশমিক ৫৯ শতাংশে এবং ২০০১ সালে অঙ্কটা দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৫৯ শতাংশে। ভোটারের উৎসবমুখর পরিবেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। সে নির্বাচনে ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট উৎসব দেখা যায়নি। যদিও ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচন নিয়ে ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থুল’ কারচুপির যত অভিযোগই উঠুক না কেন, ভোটারদের মনে কোনো ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়নি। ভোটারদের সেই স্বতঃস্ফূর্ততার যথাযথ মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট প্রদানের ভেতর দিয়ে বিজয়ী হলো, সেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার পরের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারল না। দলীয় সরকারের অধীনে একতরফাভাবে নির্বাচন করল এবং ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪০ দশমিক ০৪ শতাংশ। মানুষ ভোটের জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন। সে পথ ধরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বলা যায় মানুষের ভোটাধিকারকে অভিনব পন্থায় হরণ করা হলো। যে নির্বাচন মানুষের কাছে একটি অন্যতম উৎসব ছিল, সে নির্বাচন পরিণত হলো একটি ‘খেলো’ আয়োজনে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-৮ আসন উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪.৫%। অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের পর মনে করেছিলাম, নতুন কমিশন এমন কিছু সাহসী উদ্যোগ নেবে, যাতে কমিশন ও আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর বিরাজমান আস্থার সংকট কাটবে। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে জনমনে আশাবাদ সৃষ্টি হবে। দুর্ভাগ্যবশত কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন যেন পুরোনো পথেই হাঁটছে। এটি কারও অজানা নয় যে, পুরোনো পথে হাঁটলে নতুন গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান কমিশন যে কয়টি দৃশ্যমান কাজ করেছে, তার প্রায় সব কয়টিই ছিল গতানুগতিক, ছকবাঁধা। কমিশনের প্রথম উদ্যোগ ছিল কয়েকটি সংলাপের আয়োজন করা। সমাজের নানা ক্ষেত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এনে গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে বক্তৃতার সুযোগ করে দিলে সংলাপ হয় না। সংলাপের উদ্দেশ্য সমস্যার সমাধান, চটকদার বক্তৃতা প্রদান নয়। এটি সাধারণত করা হয় পর্দার অন্তরালে, সময় নিয়ে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সংলাপে যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা কি কমিশনের সদস্যদের অজানা? তারা তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেননি! এসব গুরুত্বপূর্ণ কথা আগেও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে কিংবা গণমাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা বহুবার বলেছেন। আগের সংলাপের কার্যবিবরণীতেও এর অনেকগুলোই লিপিবদ্ধ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সাহসী হতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় সরকারি দল না চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন সহজ নয়। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করলে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের পরোক্ষ চাপ থাকবে। ইতোমধ্যে আমেরিকা তাদের ভিসা নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্ট করেছে। সে যে দলই হোক সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাঁধা দিলে তাদের ভিসা দেবে না আমেরিকা। তবে বিদেশিদের চাপ সরকার কীভাবে নেবে তা বলা কঠিন। আইন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত থাকেন। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাহী বিভাগ ক্ষমতাসীনদের নির্দেশনার বাইরে যেতে পারে না, এমনকি তারা ভবিষ্যতে বেনিফিট নেওয়ার চিন্তা করে। তাই বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থায় শুধু নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত রাখতে হবে। এখন দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে কি না!

          মুক্ত লেখক