কাজী আশফিক রাসেল: ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়…’। সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহর দরদমাখা কণ্ঠের কালজয়ী গান এটি। জন্মভূমির প্রতি মানুষের হৃদয়ে আজন্ম লালিত এক দুর্নিবার আকর্ষণ, ভালোবাসা ও মমত্ববোধ অত্যন্ত গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে ইট-পাথরের শহরে আবাস গড়লেও কর্মব্যস্ত মানুষের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, নিজ গ্রামে। যেখানে রয়েছে মানুষের নাড়ির টান।
সেই নাড়ির টানে যে কোনো উৎসব-পার্বণে বাড়ি ফিরতে শুরু করে যান্ত্রিক শহরে কর্মব্যস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বাস, ট্রেন বা লঞ্চের টিকিটপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ হ্যাপা পোহাতে হয় ঘরমুখো মানুষকে। তবুও নিজের জন্মস্থান ও প্রিয়জনদের সঙ্গে উৎসব উদ্যাপনে সর্বদা উদগ্রীব মানুষ।
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রতি বছর ঈদযাত্রায় পুনরাবৃত্তি হয় একই ধরনের ঘটনার। ঈদ উৎসবের আগ মুহূর্ত থেকেই প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, বেহাল সড়ক, দীর্ঘ যানজট, রুগ্ণ পরিবহনব্যবস্থা, টিকিট কালোবাজারি, নিয়ন্ত্রণহীন ভাড়া বৃদ্ধি, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ যখন চরমে ওঠে, তখন ঘরমুখো মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়।
অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত, দেশের কোনো পথই ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। আমাদের দেশে গণপরিবহনে যাত্রী চলাচল যে কতটা নিরাপত্তাহীন তা প্রতিদিন হতাহতের সংখ্যা থেকে খুব সহজেই অনুমেয়। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত তিন ঈদে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮০০ মানুষ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ঈদুল ফিতরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৩৯ জন।
ঈদ উপলক্ষে ঘরে ফেরা অতিরিক্ত মানুষের চাপ পড়ে যানবাহনগুলোয়। আর এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বাতিল ও পুরোনো যানবাহন ন্যূনতম মেরামত করে রাস্তায় নামিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এসব পুরোনো পরিবহন হঠাৎ বিকল হয়ে পড়লে রাস্তায় সীমাহীন যানজটের পাশাপাশি অহরহ দুর্ঘটনায় শিকার হয় অসংখ্য মানুষ। ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীদের সর্বস্বান্ত করতে বিভিন্ন চক্র ওঁৎ পেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব চক্রের সঙ্গে পরিবহন কর্মচারীদের যোগসাজশও থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎসব-পার্বণে যাত্রী ও ক্রেতাকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। আর আমাদের এখানে উল্টো; প্রায় সব পরিবহন সংস্থা যাত্রীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এটি সত্যিই দুঃখজনক।
ঈদ বা অন্য কোনো পার্বণে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে যে কয়েকগুণ বেশি মানুষ চলাচল করে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ আদৌ ভাবিত হয় বলে মনে হয় না। ঈদের আগে কিছু ট্রেনের বগি বাড়িয়ে, কিছু ভাঙা সড়কে চুনকাম করে, মহাসড়কে যান চলাচলের বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করে। ফলে ঈদের সময় যাত্রীসাধারণ শুধু অবর্ণনীয় দুর্ভোগেরই শিকার হয় না, বহু পরিবারে ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদের সময় বর্ধিত বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চলাচল সামাল দিতে প্রয়োজন টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ।
বর্ধিত যাত্রীর কথা মাথায় রেখে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের সংখ্যা বাড়াতে হবে; তাই বলে ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়কে নামানো যাবে না। ঈদের সময় পরিবহন মালিকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়, তাও বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতি যে ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি আমলে নিলে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়।
পরিশেষে একটাই চাওয়া ঈদ হোক আনন্দের। নির্বিঘ্ন হোক ঈদযাত্রা। ঈদ উৎসব সামনে রেখে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ও দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করুক। দায়িত্ব নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক ঘরমুখো মানুষের। তবে এটাও সত্য, আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রত্যেকের সড়ক আইনবিধি মেনে চলা উচিত।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়