সুকান্ত দাস: ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। প্রতিদিন অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ। ডেঙ্গুর প্রকোপে এ বছর এখন পর্যন্ত ৩৯৮ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। হাসপাতালে ভর্তি ৯০ হাজারের বেশি মানুষ। একপ্রকার মহামারি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কভিড মহামারির পর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর ৫ থেকে ৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ছিল অন্যান্য সব সময়ের চেয়ে বেশি। ওই সময় সারাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক ছিল। মৃত্যু হয় দুই শতাধিক মানুষের। শিশুরাও অধিক হারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ২০০০ সালে, ৯৩ জন।
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে। এডিস মশার লার্ভা ছয় মাসের বেশি সময় শুকনো জায়গায় জীবিত থাকতে পারে। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে এ লার্ভা থেকে এডিস মশার সৃষ্টি হয় এবং বাসাবাড়ির আশপাশে ফুলের টবে, অপরিষ্কার পাত্রে পানি জমে এটা বংশবিস্তার করে। ডেঙ্গু হলে রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্তে প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনও বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
ডেঙ্গু জ্বর হলে চার-পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল এলার্জির মতো র্যাশ হতে পারে। শরীরে প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। মানুষের রক্তে স্বাভাবিকভাবে প্লাটিলেটের পরিমাণ প্রতি ঘন মিলিমিটারের দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ। কিন্তু ডেঙ্গু হলে রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। তখন রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন-প্রস্রাব অথবা মলের সঙ্গে রক্তপাত, নাক, দাঁত এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত ইত্যাদি। এ সময় শরীরে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়। আর করোনার সংক্রমণর সব থেকে ভয়াবহ সময়ে রোগীর জন্য রক্ত সরবরাহও প্রায় অসম্ভব। বিত্তশালীদের হয়তো কোনো সমস্যা হবে না। তবে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়বে। কারণ চিকিৎসার খরচই জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়, তার ওপর রক্ত কীভাবে জোগাড় করবে।
নির্মাণাধীন বাড়িতে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার জš§ হয়। কারণ সেখানে পানি জমে থাকে এবং সেগুলো তদারকির ব্যবস্থা একেবারেই কম। এ কারণে নির্মাণাধীন বাড়ির মালিকদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণাধীন বাড়ির মালিকদের সচেতন করা হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু কারও টনক নড়ছে না।
গত বছর ঢাকা সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমে এক বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। এ বাড়িতেই এর আগে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় একই কারণে। তার মানে একবার জরিমানা এবং সতর্ক করার পরও তারা সচেতন হননি। সব থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম ওই বাড়ির মালিকের কথা শুনে। তিনি বলেছেন বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন, তা পানি কোথায় আটকে থাকল সেটা দেখার দায়িত্ব কি আমার নাকি! এগুলো প্রতি বছরের ঘটনা। এমনই হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। জনগণ একদমই সচেতন না। আর কর্তৃপক্ষের মশক নিধন কার্যক্রম সব জায়গা সমানভাবে চলছেও না। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণ এবং কর্তৃপক্ষ সবার এক হয়ে কাজ করতে হবে।
বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী কোনো স্থায়ী সমস্যা ছাড়াই ডেঙ্গু থেকে আরোগ্য লাভ করেন। ঠিকমতো চিকিৎসায় মৃত্যুহার ১ শতাংশেরও কম। তাই যথাসময়ে চিকিৎসা নিলে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কিছু বুঝতে ওঠার আগেই রোগীর অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে অধিকাংশ সময়ই ডাক্তাররা সমলাতে পারছেন না। আর এমারজেন্সি অবস্থায় এর চিকিৎসা ব্যয়ও প্রচুর। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার শহরের বিভিন্ন বস্তিতে থাকা মানুষই বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। আর এখানে খুব বেশি শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ নেই বলে তাদের সচেতন করতে পারছে না কেউ। এ কারণেই ডেঙ্গু অনেকটা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এজন্য এসব এলাকায় সচেতনতামূলক ক্যাম্প করা উচিত।
এডিস মশা সাধারণত স্থির এবং পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বাড়ির আশপাশে যেন কোনো জায়গায় পানি না জমে তা দেখতে হবে। বাড়ির আশপাশে ভাঙা পাত্র, টব, বোতলসহ কোথাও যেন জল জমে না থাকে তা খেয়াল করতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন রকম কীটনাশক, মশা নিরোধক স্প্রে করা যায়। কিন্তু তাতে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তাই এগুলো না করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, মশা সৃষ্টির স্থান ধ্বংস করতে হবে।
এডিস মশা সকাল ও সন্ধ্যার সময় বেশি কামড়ায়। তাই এ সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
শিশুরা বেশি ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই অভিভাবকদের এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। শিশুরা অনেক সময় ঘুমিয়ে থাকে। এ সময় মশারি অবশ্যই টানাতে হবে। আর শিশুরা আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু জ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। তাই রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস বা পাকা পেঁপের জুস পান করলে উপকার পাওয়া যাবে বলে মত দিয়েছেন গবেষকরা।
প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।
এ বছর ডেঙ্গু যেন এক প্রকার নীরবে মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবার সচেতনতাই এখন একমাত্র ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়