নীলফামারীতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত কৃষক

তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী: শীতকালীন সবজি চাষে আগাম কাজ শুরু করেছেন নীলফামারীর কৃষক। এবার বর্ষার পর মৌসুমি আবহাওয়া ও টানা বৃষ্টির কারণে নতুন প্রযুক্তিতে সবজির বীজতলা তৈরি করেন কৃষক, এখন চারা লাগানো হচ্ছে ক্ষেতে।

জেলার ছয় উপজেলায় অধিকাংশ জমিতেই লাগানো আছে রোপা আমন। তাই এখন চলছে অপেক্ষার পালা, তবে যেসব জমি উঁচু এবং আমন আবাদ সম্ভব হয়নি, সেসব জমিতে লাগানো হচ্ছে আগাম জাতের ফুলকপি ও বাঁধাকপিসহ নানা জাতের সবজি। এর মধ্যে রয়েছে মুলা, টমেটো, বেগুন, পুঁইশাক, পালংশাকসহ বিভিন্ন জাতের শীতকালীন সবজি।

এবার বর্ষার দু’মাস বিশেষ করে আষাঢ়ের শুরুতে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি থাকলেও পরে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল অনেক কম। কিন্তু ভাদ্রের শেষদিকে এবং আশ্বিনের প্রথমে এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অফিস সূত্রমতে, বর্ষা মৌসুমের একবারে শুরুতে বৃষ্টির গড় পরিমাণ ছিল ৫৪৭ মিলিমিটার। এর পরে পুরো মৌসুমে বৃষ্টি ছিল মাত্র প্রায় ৪৩৮ মিলিমিটার। তবে আশ্বিন মাসে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। বর্তমানে কার্তিক মাসে হালকা শীতের কারণে খরা মৌসুম চলছে।

অসময়ে আশ্বিনে অতি বৃষ্টির ফলে জেলা সদরসহ ছয় উপজেলায় ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, ও সৈয়দপুরে বন্যা দেখা দেয়। এতে আগাম শীতকালীন শাকসবজির বীজ বপন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু কৃষক এ জন্য বসে থাকেনি। বাঁশের মাচা বানিয়ে বীজতলা তৈরি করেন তারা। এ দৃশ্য চোখে পড়ে জেলার প্রত্যক উপজেলায়। ওইসব বীজতলার চারা তুলে এখন লাগানো হচ্ছে অনাবাদি ও উঁচু জমিতে।

সদর উপজেলার দুর্বাছড়ি মালিপাড়া গ্রামের কৃষক কমলা ঠাকুর জানান, আশ্বিন মাসে অতি বৃষ্টির কারণে রাস্তার পাশে বাঁশের মাচা বানিয়ে ফুলকপির বীজতলা তৈরি করেছেন। জমিতে পানি জমে থাকায় ১০ ফুট লম্বা ও চার ফুট চওড়া ওই বাঁশের মাচায় এক গ্রাম বীজ বপন করা যায়। এভাবে তিনি তিনটি বীজতলা তৈরি করেছেন। ফুলকপির তৈরি ওইসব বীজতলার একেকটি থেকে ২২ শতাংশ জমিতে চারা লাগানো যাবে।

একই গ্রামের দুলাল চন্দ্র রায় জানান, তিনি অনাবাদি এক বিঘা জমিতে ফুলকপি লাগিয়েছেন। বাঁশের মাচায় বীজতলা বানিয়ে আশ্বিন মাসের প্রথম দিকে ফুলকপির চারা লাগিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে ওই কপি বাজারে বিক্রি করা যাবে।

কৃষক আবুল কালাম আজাদ জানান, এক বিঘা জমির চারা উৎপাদন, হালচাষ, কিষান খরচ, ওষুধ ও সারসহ খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। আর এক বিঘা জমিতে কপি ফলবে প্রায় তিন হাজার ৫০০টি। প্রতিটি কপি ১০ টাকা হলে মূল্য দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টাকা। এতে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হবে প্রায় ২০ হাজার টাকা।

সদরের চড়চড়াবাড়ী গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম জানান একই কথা। নিজস্ব উদ্যোগে বাঁশের মাচা তৈরি করে পলিথিনের ছই বা টোপর বানিয়ে সবজির বীজতলা তৈরি করেন। বৃষ্টি হলে সেটি ঢেকে দেওয়া এবং প্রয়োজন মতো তা তুলে ফেলা যায়।

তাদের মতে, এ পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে চারা তুলে ক্ষেতে লাগাতে হয়, মোটামুটি ৫৫ দিনের মধ্যে বিক্রি করা যায়। আগাম সবজি চাষে মাচা পদ্ধতির বিকল্প নাই। সনাতন পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা হলে কার্তিকের শেষের দিকে তা রোপণ করতে হবে। তখন বাজারে সবজির চাহিদা তুলনামূলক কম থাকে। আর কপি উঠতে সময় লাগবে ৬৫ থেকে ৭০ দিন। মাচায় বীজতলা তৈরি এ অঞ্চলে একেবারে নতুন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৮২৪ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭৯৮ টন। আর এখন পর্যন্ত সবজি লাগানো হয়েছে এক হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে। এসব সবজির মধ্যে রয়েছে বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, পালংশাক, পুঁইশাক, বরবটি, টমেটোসহ প্রায় ১০ ধরনের সবজি জাতীয় ফসল। এসব ফসল পুরোপুরি লাগানো শুরু হবে আর ওমাস খানেক পর। তবে আগাম জাতের কিছু কিছু ফসল লাগানোর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এবার বিলম্বের বৃষ্টি আগাম সবজি আবাদের কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে।

নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আবুল কাশেম আযাদ জানান, কৃষক এখন অনেক সচেতন হয়েছে। তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী হচ্ছে মাচা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বীজতলার চারা নষ্ট হয় না। যেমন পানি থেকে রক্ষা পায়, তেমনি প্রখর রোদ থেকে রক্ষা করতে ঢেকে দেওয়া যায়। এভাবে নীলফামারী কৃষি অঞ্চলের কৃষক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পোকা মাকড়ের আক্রমণকে মোকাবিলা করে ফসল ফলাচ্ছে। এছাড়া আগাম সবজি চাষ করে ভালো ফলনসহ বাজারে আশানুরূপ দাম পাওয়া যায়।