নৈতিকতা আছে বলেই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ

জহুরা শিকদার: নৈতিকতা একটি সমাজের ভিত্তিস্বরূপ। নৈতিকতা ছাড়া কোনো সভ্য সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। শুধু তা-ই নয় নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের কারণে একটি উন্নত  সভ্যতারও পতন ঘটতে পারে। অতীতে যত সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার প্রধান কারণ হলো সেই সভ্যতার মানুষের নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।

আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগে জল, স্থল আর আকাশ সর্বত্র উন্নতি, প্রগতি এবং সফলতার জয়ধ্বনি আমাদের কর্ণকুহরে নাড়া দিচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো শুধু নৈতিকতার ক্ষেত্রেই উন্নতি হচ্ছে না বরং সত্যিকার অর্থে নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে আজ।

নৈতিকতা হলো উত্তম আচরণ। এটি আমাদের উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কাজের মধ্যকার ভালোÑমন্দ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্যকারী।

আর নৈতিক অবক্ষয় বলতে বোঝায় নৈতিক মূল্যবোধের অভাব। অর্থাৎ সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, কল্যাণবোধ ইত্যাকার গুণাবলি লোপ পাওয়াকে বলে অবক্ষয়। মানুষ নীতি- নৈতিকতার ধারক ও বাহক। নৈতিকতাবোধই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। সেই নৈতিকতাবোধই যদি না থাকে, নৈতিকতার চর্চা না থাকে তাহলে মানুষ আর চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। পশুর যেমন ভালো-মন্দ জ্ঞান নেই। সে যা ইচ্ছে তাই করে। নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষও তেমন ভালো-মন্দের তোয়াক্কা করে না। আবেগের বশবর্তী হয়ে তার যা মনে চায় তাই করে বেড়ায়। অন্যদিকে নৈতিক মূল্যবোধ ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মন্দ কাজে বাধা দেয়। আর নৈতিকতার অবক্ষয় মানুষকে পশুবৃৃত্তির দিকে নিয়ে যায়। যেমন : একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবার প্রয়োজন। এখন সে খাবার চুরি করে আনবে না নিজে কাজ করে জোগাড় করবে তা নির্ভর করে তার নৈতিক মূল্যবোধের ওপর। একজন নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি কখনোই চুরি করে খাবার খাবে না। কারণ সে জানে চুরি করা নৈতিকতার পরিপন্থি কাজ। তাই নৈতিকবোধ সম্পন্ন মানুষ চাইলেই যেকোনো কাজ করতে পারে না। তাকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্য থেকে সব কাজ করতে হয়। নৈতিকতার এই চর্চাই একটি সুশীল সমাজ ও আদর্শ মানুষ গড়ে তোলে।

দুঃখজনক সত্য, আমাদের মাঝে এখন নৈতিকতার চর্চা নেই। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় প্রতীয়মান হচ্ছে। একমাত্র নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, ভেজাল মিশ্রণসহ যাবতীয় অনৈতিক কাজ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছে। হত্যা, গুম করণ, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি, অপহরণ, সহিংসতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, ঠকবাজি, নারী ও শিশু পাচার প্রভৃতি একেকটা নৈতিকতার ব্যাধিসরূপ। বর্তমান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই ব্যাধিগুলো ঢুকে গেছে। পর্নোগ্রাফি আর মাদকের মতো ভয়াবহ ব্যাধিতে তরুণ সমাজ আজ আক্রান্ত। ফলশ্রুতিতে ধর্ষণ, ইভটিজিং, বেহায়াপনা, নগ্নতা, অশ্লীলতা ইত্যাদি অনৈতিক কাজগুলো দিন দিন বেড়ে চলছে। পশ্চিমা সভ্যতার নগ্ন সংস্কৃতির করাল গ্রাসে তরুণ সমাজ জর্জরিত, যা তাদের অবৈধ সম্পর্ক, ফ্রিমিক্সিং, লিভ টুগেদার ও সমকামিতার মতো অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত করে তুলছে। আগে সামাজিকতার খাতিরে হলেও মানুষ এসব কাজ করা থেকে বিরত থাকত। কিন্তু এখন নৈতিকতার এতটা অধঃপতন হয়েছে যে লোকচক্ষুর পরোয়া না করে দিবালোকে এসব অনৈতিক কাজ অহরহ করে বেড়াচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজš§কে এসব অনৈতিক কাজের দিকে ধাবিত করছে।

বর্তমানে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনৈতিক কাজের একটা নতুন প্লাটফর্ম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনৈতিক কাজের পরিমাণ বেড়ে চলছে। কারণ এখানে বাধা দেয়ার মতো কেউ নেই। বর্তমান তরুণ সমাজ সোশ্যাল মিডিয়ায় মারাত্মকভাবে আসক্ত। অনলাইনে যথেচ্ছ সময় ব্যয় করার কারণে তারা আর কোনো ক্রিয়েটিভ ও প্রোডাক্টিভ কাজ করতে পারছে না। বাস্তবতা থেকে তারা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহার তরুণ সমাজকে তথ্যের ক্ষেত্রে যতটা না এগিয়ে দিচ্ছে, নৈতিকতার দিক থেকে তার চেয়ে কয়েকগুণ পিছিয়ে দিচ্ছে।

নৈতিক অবক্ষয়ের প্রধান কারণ মূল্যবোধের অভাব অর্থাৎ নৈতিক বিশ্বাসের অভাব। মানুষ প্রতিটি কাজ তার বিশ্বাস অনুযায়ী করে। মানুষ যখন নৈতিকতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, নৈতিকতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে তখনই নৈতিকতার চর্চা থেকে দূরে সরে যায়। আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার বস্তুবাদী শিক্ষা ও আকাশ সংস্কৃতির ফলে মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ হ্রাস পাচ্ছে যা নৈতিকতার চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে মানুষ হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক। এছাড়া অসুস্থ বিনোদন, ধর্মীয় বিশ্বাসের ও নৈতিক শিক্ষার অভাব অজ্ঞতা, পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি, সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহার, পারিবারিক বন্ধনের অভাব, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসনের অভাব নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।

তরুণদের শক্তি ও সাহস, শিক্ষা ও নৈতিকতা দেশের উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু সে তরুণ সমাজ যদি নৈতিকতা বিবর্জিত হয় তাহলে শুধু শিক্ষা আর অর্থ দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। একজন নৈতিকতাবিহীন মানুষ হয় স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও চরিত্রহীন। এ ধরনের মানুষ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন অসম্ভব। তাই দেশের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে বর্তমান তরুণ সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এজন্য প্রয়োজন তরুণদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা, মানবীয় জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে হলে তরুণদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান, সুস্থ বিনোদন, সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, আদর্শ মানুষের অনুসরণ, সুষ্ঠু সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিশেষজ্ঞদেও যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা এবং এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়