নৌপথে তেল দূষণ রোধে কঠোর হোন

 

জ্বালানি তেল বহনকারী ট্যাংকারের সঙ্গে ফ্লাই অ্যাশবাহী কার্গো জাহাজের মুখোমুখি সংঘর্ষে কীর্ত্তনখোলা নদীতে ট্যাংকারের তলা ফেটে পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের ঘটনা দেশে নতুন নয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের অধিক ফার্নেস তেল বহনকারী একটি ট্যাংকার ডুবে যায়। এতে সেখানকার পরিবেশের বড় ক্ষতি হয়েছিল। জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠেছিল। উপকূলবর্তী বন্যপ্রাণীও হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত। কীর্ত্তনখোলার দুর্ঘটনা সে মাত্রার না হলেও একে ছোট করে দেখা যাবে না। নৌপথে কিছুদিন পরপরই নৌযানগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। কতটা অসতর্ক হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তা চিন্তাও করা যায় না। নৌপথ তো সড়কপথের মতো যানবহুল নয়। এছাড়া তেলবাহী ট্যাংকার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নদী বা সমুদ্রের পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়লে ক্ষতি হয় মূলত দুই ধরনের। প্রথমত, পরিবেশের ক্ষতি হয়, যা পুষিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগে। দ্বিতীয়ত, মূল্যবান জ্বালানি তেলের অপচয় ঘটে। উপকূলবর্তী দুর্ঘটনায় স্থানীয়রা পানি থেকে কিছু তেল তুলে নিয়ে আলাদা করে হয়তো তাদের ছোটখাটো জ্বালানি চাহিদা মিটিয়ে থাকে। কিন্তু এ ধরনের দুর্ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

দেশের সমুদ্রপথে প্রায় প্রতিদিন ৪১ থেকে ৭০ বছরের পুরোনো ট্যাংকারের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হচ্ছে। অথচ নিয়মানুযায়ী ৩০ বছরের অধিক বয়সী ট্যাংকার দিয়ে তেল বহনের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্সের ধারা ৩০ অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী জাহাজের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। দুবার বিশেষ ডকিং সার্ভে উন্নীত হতে পারলে সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত চালানো যাবে অয়েল ট্যাংকার। কিন্তু উপকূলীয় তেলবাহী ট্যাংকারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকায় ৭০ বছরের পুরোনো ট্যাংকারও সেখানে যাতায়াত করছে। খোদ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) মালিকানাধীন ট্যাংকারগুলোর সবচেয়ে পুরোনোটির বয়স ৭০ বছর। বেসরকারি মালিকানাতেও রয়েছে এমন পুরোনো ট্যাংকার। নৌপথে চলাচলকারী যানের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক এ তেলবাহী ট্যাংকার। পুরোনো ট্যাংকার থেকে অধিক তেল নৌপথে মেশে। অনেক দেশেই ২৫ বছরের পুরোনো অয়েল ট্যাংকার চলতে দেওয়া হয় না। দেশের ৬০ শতাংশ অয়েল ট্যাংকার এক স্তরের কাঠামোবিশিষ্ট। ২৫৬টি ট্যাংকারের ১৫৬টিই বালিবাহী বাল্কহেড থেকে তেলবাহী ট্যাংকারে রূপান্তর করা হয়েছে। এগুলো আসলে তেল বহনের উপযোগী নয়। সিঙ্গেল বটম ও সিঙ্গেল হালবিশিষ্ট এসব ট্যাংকার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যে কোনো সময় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য জ্বালানিবোমায় পরিণত হয়ে উঠতে পারে।

পুরোনো ট্যাংকারে জ্বালানি অপচয় হওয়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ৪০ বছরের পুরোনো ট্যাংকারে তেল বহন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পুরোনো ট্যাংকার মালিকরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তদবির চালিয়ে আরও পাঁচ বছরের জন্য তাদের জাহাজগুলো চালানোর অনুমতি লাভ করেছেন। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর একশ্রেণির কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে কাজ চালানোর অভিযোগও রয়েছে। একবারে অনেক পুরোনো জাহাজ বাতিল করে দিলে অবশ্য এ খাতে শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা মনে করি, পরিবেশের ক্ষতি ও জ্বালানি তেলের অপচয় করেÑপুরোনো ও অনুপযোগী এমন অয়েল ট্যাংকারগুলো ধীরে ধীরে সমুদ্র ও নদী উভয় পথ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। নৌযানের দুর্ঘটনা রোধে আরও সতর্ক হতে হবে চালক ও কর্তৃপক্ষকে। যাদের অসতর্কতা ও গাফিলতির জন্য এসব দুর্ঘটনা ঘটে পরিবেশের ক্ষতি হয়, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়েও কঠোর হতে হবে। দুর্ঘটনা সামাল দেওয়া ও জলজ সম্পদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর সে অর্থ তো কোনো না কোনো খাত থেকেই ম্যানেজ করতে হয় সরকারকে।