Print Date & Time : 18 August 2025 Monday 4:44 pm

ন্যাম সম্মেলনে যোগদান ও বঙ্গবন্ধুর আলজিয়ার্স সফরের ৪৫ বছর

কাজী সালমা সুলতানা: আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ওই সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রসভায় সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। সে সম্মেলনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরব, আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ গ্রহণ করেন।
ওই সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাগত ভাষণ, পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর সমাপনী বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনের ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাগত ভাষণ নানা কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। সদ্য স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতির দর্শন তিনি ওই ভাষণে উপস্থাপনের সুযোগ গ্রহণ করতে পিছপা হননি। তিনি ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির কথা তুলে ধরেন। এ অন্তর্ভুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদবিরোধী মজলুম জনগণের ন্যায়ানুগ সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন জোগানো। জোটনিরপেক্ষ নীতি তাঁর পররাষ্ট্রনীতির দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী জনগণ ও রাষ্ট্রগুলোর আস্থা অর্জনের পথে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তিনি তাঁর বক্তব্যে বিশ্বময় শান্তির গুরুত্ব তুলে ধরে শান্তি, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার প্রতি গণমানুষের চিরায়ত আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি করেন। সে লক্ষ্যে গণমানুষ সর্বদাই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুগে যুগে লড়াই করেছে। উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও বর্ণবাদীদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং তাদের মুক্তিসংগ্রামকে জয়যুক্ত করার কথা তাঁর স্বাগত ভাষণে স্মরণ করেন। রাষ্ট্রের স্বাধীন স্বত্বা, জাতীয় সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকারের কথাও তুলে ধরেন, যা গণমানুষের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে সুখী-সুন্দর জীবনের মূল উপাদান রচনায় সহায়ক হতে পারে।
তিনি সেদিন স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন আজও আরব ভূখণ্ড ইসরাইলের অবৈধ দখলে। তারা ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করে চলেছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজও অব্যাহত এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাওসহ ল্যাটিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। বর্ণবাদের কালো থাবা আজও দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণকে পীড়িত করছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের জনগণের পূর্ণ মুক্তির আন্দোলন এখনও বিজয়ের মুখ দেখেনি। তিনি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের নেতাদের প্রতি আহ্বান রাখেন এ সম্মেলন আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের জাতীয় ও আইনগত অধিকার আদায়ের লড়াই সমর্থন করে।
আমাদের এ উপমহাদেশের মানবিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার কথা বঙ্গবন্ধু এ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। মানবিক সমস্যার সমাধান উপমহাদেশের শান্তির পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিশ্বময় নিরস্ত্রীকরণের গুরুত্ব তুলে ধরে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং যুদ্ধে সম্পদ বিনাশের কবল থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষার প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষের জরুরি চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করার প্রতিও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, নিরক্ষরতা, রোগ-জরামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকেন। এ স্বপ্ন পূরণে তিনি মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর আস্থা রাখেন। কী করে একজন প্রত্যয়ী মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে এ ব্যাপারে সমসাময়িক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেরান তিনি। তিনি মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যবহারের আহ্বান রাখেন, কিন্তু যুদ্ধবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরিতে নয়।
স্বাগত ভাষণে তাঁর শেষ কথা: রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জোটনিরপেক্ষ সদস্য দেশগুলোর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার সাধারণ প্রত্যয় দেশগুলোর সামাজিক সমৃদ্ধি আনতে পারে।
৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধু সমাপনী ভাষণ প্রদান করেন। প্রারম্ভেই এ সম্মেলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। তিনি সম্মেলনের সফল সমাপ্তির জন্য সম্মেলনের চেয়ারম্যান তখনকার আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়েরি বুমেদিন, তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকার কর্মপ্রচেষ্টা, আলজেরীয় সরকার ও জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সম্মেলন সফল হওয়ার মূল কারণ আমরা সবাই বিশ্বব্যাপী শান্তি, মুক্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে নিবেদিত।
সম্মেলনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতি যে গভীর ভ্রাতৃত্বসুলভ সংহতি প্রকাশ করেছে, সে জন্য তাদের প্রতি প্রাণঢালা ধন্যবাদ জানাতেও বঙ্গবন্ধু ভোলেননি। তিনি আরও বলেন, ‘এ সম্মেলনে আগত নেতারা আমাদের প্রতি যে উষ্ণ শুভেচ্ছা এবং আমাদের লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের প্রতি যে সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছে এসবই আমাদের প্রতি তাদের সংহতি দৃশ্যমান করেছে।’
সমাপনী বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে যোগদান করেছি এবং আল্লাহর রহমতে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সমর্থনে জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করব।’ উল্লেখ্য, সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের ৭৯ নং অনুচ্ছেদে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই সমর্থন আদায়ের পথে মূল চালিকাশক্তি ছিল। সেপ্টেম্বর ’৭৩-এ তিনি যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বরে (১৯৭৪) বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধুর আলজিয়ার্স সফরের ৪৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।