ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় এমএইচ গ্রুপ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামভিত্তিক ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জের চিটাগং সিন্ডিকেট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন মিন্টু। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি ২০০৮ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন। তবে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গত ৩০ মার্চ ব্যাংকটির খেলাপি তালিকায় যুক্ত হয় চিটাগং সিন্ডিকেটসহ সহযোগী কোম্পানিগুলো।
এ সময় তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের মোট পাওনা দাঁড়ায় ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর এ পাওনা আদায়ে বন্ধকিতে থাকা সম্পত্তি আগামী ১৮ জুলাই নিলামে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট শাখা।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের কিস্তি প্রথমদিকে নিয়মিত পাওনা পরিশোধ করত চট্টগ্রামভিত্তিক এমএইচ গ্রুপের চিটাগং সিন্ডিকেট। তবে গত কয়েক বছর ধরে ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে পুনঃতফসিল সুবিধাও নেওয়া হয়। এরপরও নিয়ম অনুসারে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় যুক্ত হয় চিটাগং সিন্ডিকেট এবং দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠান সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড ও মমতা ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড।
এ সময় তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর মধ্যে চিটাগং সিন্ডিকেট লিমিটেডের কাছে ৩৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা, সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের কাছে ২১ কোটি ৯ লাখ টাকা ও মমতা ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের কাছে ২৬ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর এ পাওনা আদায়ে বন্ধকিতে থাকা সম্পত্তি আগামী ১৮ জুলাই নিলামে বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা।
বন্ধকি জমিগুলোর মধ্যে রয়েছে চিটাগং সিন্ডিকেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন মিন্টুর নামে চট্টগ্রাম শহরের বাকলিয়া, ষোলশহর, কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, চান্দগাঁও প্রভৃতি মৌজায় ২৪৮ শতক জমি আছে। পাশাপাশি কাটগড় এলাকায় ১৭৬ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং সীতাকুণ্ডে ১৭০ শতাংশ শিল্প প্লট আছে। একই মৌজায় ১১৯ শতাংশ আবাসিক জমিও আছে। আর তার স্ত্রী উম্মে হানির নামে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় ডুমনী মৌজায় আট দশমিক ২৫ শতাংশ আবাসিক জমি ও চট্টগ্রামের দক্ষিণ পতেঙ্গায় ১২ শতাংশ উঁচু বাণিজ্যিক জমি আছে। পাশাপাশি সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে শহরের ৯ শতাংশ নাল জমি ও সীতাকুণ্ড থানা এলাকায় ৬২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ শিল্প প্লট আছে। এছাড়া এমএইচ ইম্প্রটেক্স লিমিটেডের নামে পটিয়ার ইয়াকুবদণ্ডি মৌজায় ৬৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও এমএইচ কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে আনোয়ারার বিলপুর মৌজায় ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ জমি আছে বন্ধকি হিসেবে।
ঋণের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোশাররফ হোসেন মিন্টুর মালিকাধীন খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান চিটাগং সিন্ডিকেটের নামে ন্যাশনাল ব্যাংকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণ গ্রহণের স্থিতি ছিল ৩০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে ছিল ৩২৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ছিল ৩৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। পরে পুনঃতফসিল সুবিধাও নেওয়া হয়। পাশাপাশি মোশাররফ হোসেনের মালিকানাধীন সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড ও মমতা ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে নতুন করে আরও ৪০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। ফলে সব মিলিয়ে চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিল ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, মোশাররফ হোসেন মিন্টু ২০০০ সালের পর খাতুনগঞ্জ এলাকায় ট্রেডিং ব্যবসায় আসেন। প্রথমে চিটাগং সিন্ডিকেট নামে গুঁড়োদুধ  আমদানির মাধ্যমে আলোচনায় আসেন। পরে প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধ টু ডে নামে বাজারজাতকরণে আসে। পরে আস্তে আস্তে সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড, মমতা ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড, এমএইচ ইম্প্রটেক্স লিমিটেড এবং এমএইচ কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এমএইচ গ্রুপ গড়ে তোলেন। এছাড়া কয়েক বছর আগে খাতুনগঞ্জ এলাকায় দাদন ব্যবসায় আসেন। এ ব্যবসায় পলাতক ইয়াসির এন্টারপ্রাইজের মোজাহেরসহ বেশ কিছু টাকা পার্টির কাছে আটকে যায়। পাশাপাশি ঋণের টাকায় অতিরিক্ত জমি কেনেন এবং বিদেশেও পাচার করেছেন বলে শুনেছি।
এ বিষয়ে জানতে চিটাগং সিন্ডিকেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন মিন্টুর সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি। পরে খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেট এমএইচ গ্রুপের অফিসে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঋণখেলাপির বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন মিন্টু ২০০৮ সালে চিটাগং সিন্ডিকেট নামে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। প্রতিষ্ঠানটি গুঁড়োদুধ আমদানির মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বস্তায় বস্তায় তা সরবরাহ করা হতো। অপরদিকে প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধ টু ডে নামে বাজারজাত করে। এ প্রতিষ্ঠানের মুনাফায় গড়েন একাধিক প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি কয়েক বছর আগে খাতুনগঞ্জ এলাকায় টু টু নামে সুদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এ ব্যবসায় বেশ কিছু টাকা পার্টির কাছে আটকে যায়। তবে তার কাছে টাকা আছে। হয়তো তিনি দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে রি-শিডিউল সুযোগ নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম বুলবুল শেয়ার বিজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি জানি না। আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে ফোন দেবেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর ফোন দিলে তিনি আর কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি।
উল্লেখ্য, প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি নিট মুনাফা করে ৪১০ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৪৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মুনাফা কমেছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল দুই হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ছিল দুই হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৪৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রভিশন সংরক্ষণ বেড়েছে, অর্থ সংগ্রহে ব্যয় বেড়েছে, বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে, রিটার্ন অন ইনভেস্টম্যান্ট কমেছে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল ব্যাংকের একাধিক সূচকে অবনতি হয়েছে।