মেহেদী কবীর : ঘুরতে যেতে হবে। নতুন বছরে প্রথম ভ্রমণ পরিকল্পনায় রাখা হলো সুনামগঞ্জকে। আমরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী এ পরিকল্পনা করি। সকাল সকাল যাবতীয় আয়োজন শেষ করে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করি। সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছাই সকাল ১০টায়। বেড়ানোটাকে রোমাঞ্চকর করে তুলতে সুনামগঞ্জ থেকে ট্রলার ভাড়া করি। মাইঠট্যান হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি চিরে এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রলার দুটি। মাঝেমধ্যে দেখা মিলছে দু’একটি ছোট ছোট গ্রামের। এভাবে চলতে চলতে ট্রলারেই দুপুরের খাবার সেরে ফেলি।
বিকালে যাদুকাটা নদীর চরে আশ্রয় নেয় আমাদের ট্রলার দুটি। মাইক্রোফোন হাতে শাকিল মাহবুব ভাই সময় বেঁধে দিলেন। আধাঘণ্টার মধ্যে ঘুরেফিরে ট্রলারে ফিরে আসতে হবে।
কিন্তু কে শোনে সে কথা? চোরাবালির মতো বিস্তৃত বালি-পাথরের এলাকা ও যাদুকাটা নদীর চর পেয়ে একঘণ্টার আগে ট্রলারে ফেরানো গেলো না কাউকে।
এরপরের গন্তব্য ছিল বারিক টিলা। এবার ভ্রমণের সময় ১০ মিনিটি বাড়িয়ে চল্লিশ মিনিট করা হলো। কিন্তু যে টিলায় উঠতেই লাগে ২০ মিনিট, সেখানে কি আর সময়ের সীমাবদ্ধতা খাটে? টিলার ওপরে একটু এগোলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী দীপা খন্দকার ছবি তুললো সীমান্তে গিয়েই। নেমে আসতে আসতে এবারও ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এবার যেতে চাই ট্যাকের ঘাট। ট্রলার মালিকের কাছ থেকে জানতে পারি, টেকের ঘাট যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। আমরা একটুও না দমে সেদিকে রওনা দিই। ট্যাকের ঘাট পৌঁছতে পৌঁছতে হাওরে সন্ধ্যা নেমে আসে। তখন সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়ি সবাই।
একটু পরে জোছনায় ভেসে যায় গোটা এলাকা। জোছনা উপভোগ করতে করতে রাত সাড়ে ৮টায় টেকের ঘাটে পৌঁছে যায় আমাদের ট্রলার।
সেই রাত আমরা ট্রলারে কাটিয়ে দিই। নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে স্মরণীয় করে রাখি রাতটি। ফটোগ্রাফার আরিফুর মান্না তখন উপস্থাপকের ভূমিকায়। তার সহযোগী শাহেদ ইসলাম। তাদের উপস্থাপনায় জমে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রায় সবাই কিছু না কিছু পারফর্ম করি তখন। এরপর একটু দেরিতেই সেরে ফেলি রাতের খাবার। রাত প্রায় শেষ বললেই চলে তখন!
পরের দিন সকাল ৬টায় বেরিয়ে পড়ি। হেঁটে হেঁটে আমরা নীলাদ্রি লেকে চলে যাই। লেকের উঁচুনিচু টিলার ফাঁকে ফাঁকে ঠিকরে পড়েছিল সকালের সোনামাখা রোদ্দুর। সেখান থেকে গাইড আমাদের নিয়ে গেলো টেকের ঘাট টিলায়। টেকের ঘাট ছড়ার বিশুদ্ধ পানিতে তেষ্টা মিটিয়ে নিই আমরা। সেখান থেকে ফিরে লাকমাছড়া ঝরনায় যাই গোসলের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে মাতৃতান্ত্রিক গারোদের লাকড়ি বিক্রি ও বাজার-সদাই করার দৃশ্য দেখতে পাই। এরই মাঝে টেকের ঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পটিও ঘুরে এলাম সংক্ষিপ্ত সময় নিয়ে। এবার তড়িঘড়ি করে সকালের খাবার খেয়ে যাত্রা শুরু টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে।
ফালইবিল পার হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ করে আমাদের ট্রলার। গাইড জানান, স্থানীয়দের কাছে ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামে পরিচিত এ হাওর। ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এটি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। ভারতের মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিশেছে এখানে। বর্ষাকালে হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একরে।
হাওরের প্রবেশমুখে সারি সারি হিজলগাছ যেন আমাদের অভিবাদন জানালো। মূল হাওরের পানির নিচে দেখা মেলে হরেকরকম লতাপাতা জাতীয় জলজ উদ্ভিদের। মাঝে মাঝে জনবসতি। প্রায় সব বাড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখা আছে নৌকা। বর্ষাকালে এখানকার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম এটি। ওয়াচ টাওয়ারে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লাম হাওরের পানিতে। সাঁতার ও নৌকা থেকে লম্ফঝম্প যেন শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু মন না চাইলেও বাস্তবতা মেনে এবার ফেরার পালা।
যেভাবে যাবেন
দেশের যে কোনো স্থান থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে আসতে হবে। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন, মামুন পরিবহনের নন-এসি বাস যায় সুনামগঞ্জ। ভাড়া পাঁচশ থেকে সাড়ে পাঁচশ টাকা। সুনামগঞ্জ শহর থেকে হিউম্যান হলারে (লেগুনা) কিংবা মোটরবাইকে যেতে হবে তাহিরপুরে। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে একটি লেগুনার ভাড়া আটশ থেকে বারোশ টাকা। যাওয়া যাবে কমপক্ষে আটজন। মোটরবাইকে দুজনের খরচ পড়বে তিনশ থেকে চারশ টাকা। তাহিরপুর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অন্যান্য স্পটে। নৌকায় রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে। নৌকাভেদে ভাড়া পড়বে তিন থেকে ১০ হাজার টাকা।
সাংবাদিক