মহসিন মিলন, বেনাপোল (যশোর) : বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কেমিকেল ল্যাবের গুরুত্বপূর্ণ স্পেকট্রোফটোমিটার যন্ত্রটি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। ফলে আমদানিকৃত কেমিকেল-জাতীয় শিল্প কাঁচামালের মান যাচাইয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এতে পণ্য খালাসে বিলম্ব হচ্ছে ও ব্যবসায়িক জটিলতা বাড়ছে।
কাস্টমস সূত্র জানায়, পণ্যে ক্ষতিকর বা নিষিদ্ধ উপাদান রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে এই যন্ত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিকল অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে প্রতিদিন গড়ে ২৫টি নমুনা পরীক্ষার পরিবর্তে সেগুলো এখন পাঠাতে হচ্ছে ঢাকায় কিংবা চট্টগ্রামে, যা সময় ও অর্থ দুটোই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, এলসির তথ্য অনুযায়ী কোনো পণ্যে বিষাক্ত বা ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে ল্যাবের এই যন্ত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
বেনাপোল কাস্টমস ল্যাবের জন্য বরাদ্দকৃত দুটি যন্ত্রের একটি নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। নমুনা ঢাকায় পাঠাতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং খালাস পেতে সময় লাগছে ১০ থেকে ১৫ দিন। এতে বন্দর এলাকায় পণ্যজট তৈরি হচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞ তপন কুমার জানান, কেমিক্যাল পণ্যের শ্রেণিভুক্তি বিলম্বিত হলে শিল্পে কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে উৎপাদনে, বাড়ে ব্যয়, সাধারণ ভোক্তাকে দিতে হয় বেশি দাম। তিনি আরও বলেন, তেল, সাবান, কসমেটিকস ও খাদ্যশিল্পসহ অসংখ্য শিল্প এই মেশিনটির ওপর নির্ভরশীল। তিনি জানান, মেশিনটি মেরামতের জন্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। বিষয়টি বারবার কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
বেনাপোল আমদানি রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক আনু বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত টেকনিক্যাল কমিটি কেমিক্যাল শ্রেণিভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা বৈঠকে বসছে না। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি বাড়ছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমস-বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, আমরা কাস্টমসকে বহুবার অনুরোধ জানিয়েছি যন্ত্রটি মেরামতের জন্য। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ দেশের মোট আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ কেমিক্যালজাত পণ্য আসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। বেনাপোল কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার শরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা যন্ত্র মেরামতের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সমাধান হবে।
প্রসঙ্গত, বেনাপোল কাস্টমস ল্যাবে প্রতিদিন যে ২৫টির মতো নমুনা পরীক্ষা হয়, তার বেশিরভাগই শিল্প-সংক্রান্ত। ফলে ল্যাবের কার্যকারিতা বন্ধ থাকায় আমদানি, রাজস্ব এবং শিল্প উৎপাদন সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
যশোরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেনাপোল স্থলবন্দর, যা শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বেনাপোলে অবস্থিত। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সিংহভাগ এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়। সরকারি আমদানি শুল্ক আহরণে বেনাপোল স্থলবন্দরটির ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। এখানকার মানুষের জীবিকার অন্যতম সূত্র বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টমস? ক্লিয়ারিং এজেন্টের কাজ। বেনাপোল মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম, যেখানে একটি সীমান্ত তল্লাশি ঘাঁটি ও আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর অবস্থিত। এই স্থলবন্দরের শুল্ক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে বেনাপোল কাস্টম হাউস। স্থলবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ। বেনাপোল রেলস্টেশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত রেল চলাচল করে। বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের দিকের অংশটি পেট্রাপোল নামে পরিচিত। এটি পশ্চিম বাংলার বনগাঁওয়ের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ হিসাবে বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহৃত হয়। বেনাপোল থেকে কলকাতা মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে। মোট স্থলবাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এই বেনাপোলের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ভারত গমনের প্রধান পথ যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই পথে প্রতিদিন শত শত ভ্রমণকারী চলাচল করেন।