পপুলিস্ট ইমরান খান: সংকটাপন্ন পাকিস্তান

আতহার নূর: রাজনীতিতে পপুলিজম একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। ‘পপুলিজম’ শব্দ এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে বোঝায় যা অভিজাত শ্রেণি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সাধারণ জনগণের চাহিদা এবং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। পপুলিস্ট আন্দোলনগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং সামাজিক অবিচারের মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে গণমানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে সৃষ্টি হয়। পপুলিজম রাজনৈতিক স্পেকট্রামজুড়ে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে এবং কর্তৃত্ববাদ, জাতীয়তাবাদী এবং আইনের শাসনের প্রতি চরম অবহেলার সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক জান ওয়ানার মুলার ‘হোয়াট ইজ পপুলিজম’ গ্রন্থে বলেছেন, পপুলিস্টরা রাজনীতিতে জনগণের স্বার্থে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কায়েম করতে চাওয়ার প্রচলিত ধারণাটি চরম ভ্রান্ত। পপুলিস্টরা দাবি করে, একমাত্র তারাই ‘জনগণের ইচ্ছা’র কথা ভাবেন। কিন্তু বাস্তবে জনগণ নীতিনির্ধারণী বিষয় উš§ুক্ত আলোচনায় তারা মোটেই আগ্রহী নয়। এছাড়া পপুলিস্ট নেতারা অনেক সময় যুক্তিযুক্ত বিতর্কের বাইরে গিয়ে আবেগে বশীভূত হয়, ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য গণতান্ত্রিক নিয়ম লঙ্ঘন করে থাকে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে পপুলিজমের ইতিহাস রয়েছে, যেখানে পপুলিস্ট নেতারা সাধারণ মানুষের কাছে সবসময়ই তাদের চাহিদা ও স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে থাকে।

ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস ইমরান খানের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে, খান একজন সুপরিচিত ক্রিকেটার ছিলেন এবং খেলাধুলায় তার কৃতিত্ব তাকে পাকিস্তানের ঘরে ঘরে পরিচিত করে তোলে। ক্রীড়াঙ্গনের এই তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়ী এই খেলোয়াড় ক্রিকেটের ২২ গজ থেকে গণমানুষের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ।

সূচনালগ্ন থেকেই পিটিআই নিজেদের একটি দুর্নীতিবিরোধী দল হিসেবে প্রচারণা চালায়, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং দরিদ্রদের সামাজিক সেবা প্রদানের অঙ্গীকার করে। যদিও পপুলিজম ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, আবার এটি কর্তৃত্ববাদের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি অবহেলাও করতে পারে, কারণ কেউ কেউ পিটিআইয়ের সামরিক আদালতের ব্যবহার, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর ক্র্যাকডাউনসহ প্রশাসনের পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন।

ইমরান খান একদিকে ধর্মীয় ভাবাবেগ ও বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয় জনগণের হƒদয়ে। অন্যদিকে তার ইসলামিক জনতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি সামরিক বাহিনীর সমর্থন পেয়ে যায়। সে ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হয়। হয়তো এটি ছিল জনতাবাদের আরেকটি অনিবার্য উত্থান।

অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। শুরু করেছিলেন তার ‘প্রথম একশ দিনের লক্ষ্যমাত্রা’। নজরে ছিল চাষিদের ভর্তুকি দেয়া, ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো, উৎপাদনে বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানি রুপির বিনিময় মূল্য কমানো। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কারে ইমরান কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। করাচিকে ঢেলে সাজাতেও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি আগে থেকে থাকা সংকটের কারণে তেমন কিছুই করতে পারেননি তিনি। ২০২২ সালে আস্থা ভোটে হেরে বিদায় নিতে হয় তাকে। এখন তার চোখ কেবল আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে।

শুরু থেকেই খানের বাগ্মীতা এবং মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা পাকিস্তানি জনগণের হƒদয়ে জায়গা করে নিতে সহযোগিতা করেছে। উর্দু এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় আবেগের সঙ্গে কথা বলতেন এবং জনগণকে এমন একটি পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানান যেখানে ধনী এবং দরিদ্র উভয়কেই সমানভাবে বিবেচনা করা হয়। এমন একটি দেশের পরিকল্পনা যেটি পশ্চিমা শক্তির অধীন হবে না; বরং মদিনা সনদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা হবে।

এমনকি তিনি নাগরিকদের কর আদায় প্রতি উৎসাহিত করতে গিয়ে ‘জিহাদ’” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াই করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা, ধনীদের কর আরোপ এবং একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দেন।

এছাড়া ইমরান খান সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্বারোপের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বায়নেরও একজন সোচ্চার সমালোচক ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শোষণ করেছে এবং তাদের আধুনিক বিশ্বায়ন বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটিয়েছে। খানের এ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বাগ্মিতা একজন জনতাবাদী নেতা হিসেবে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত পাবলিক পলিসি রিপোর্ট শিরোনামের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ইমরান খান পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ, জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ ইতিবাচক সমর্থন পেয়ে প্রথম স্থানে অবস্থান করছেন এবং ৩৭ শতাংশ সমর্থন নিয়ে নওয়াজ শরিফ এবং বিলাওয়াল ভুট্টো দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। এছাড়া মরিয়ম নওয়াজ, আসিফ আলী জারদারি এবং মাওলানা ফজলুর রহমান সকলেই যথাক্রমে ৬১ শতাংশ, ৬৭ শতাংশ এবং ৫৭ শতাংশ নেতিবাচক রেটিং পেয়েছেন। এমনকি ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতাদের কাছ থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ নেতিবাচক রেটিং পেয়েছেন।

পাকিস্তানের ইতিহাসে আরেকজন উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় নেতা ছিলেন বেনজির ভুট্টো, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। বেনজির গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, কিন্তু তার নেতৃত্বে দুর্নীতির অভিযোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় জর্জরিত ছিল, যা শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে তাকে হত্যা করা হয়।

অতএব, ইমরান খানের ভবিষ্যতের পথচলায় সংশয় ও প্রশ্ন থেকেই যায়, ইমরান খান কি সেই তথাকথিত পপুলিস্ট নেতাদের একজন হতে যাচ্ছেন, যারা সব পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দেন। যেটি কিনা বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয়। এ কারণেই পপুলিস্ট নেতাদের প্রায়ই সংশয়ের চোখে দেখা হয়। অধ্যাপক বুল বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘সমর্থন পাওয়ার জন্য এ ধরনের নেতারা খুব দ্রুতই প্রতিশ্রুতি দেন।

অন্যদিকে ‘দ্য গ্লোবাল রাইজ অব পপুলিজম’ বইয়ে অধ্যাপক বেনজামিন মফিট লিখেছেন, ‘এই শব্দটির প্রায়ই ভুল ব্যবহার হয়।

প্রকৃত পপুলিস্ট একজন নেতা মূলত ‘জনগণের ঐক্যবদ্ধ করেন, তাহলে কি ইমরান খান ক্ষমতায় ফিরতে পারলে চতুর্মুখী সংকটে পতিত পাকিস্তানের হাল ধরবেন একজন যোগ্য সারথি হিসেবে। এটি সময় বলে দেবে।

শিক্ষার্থী

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়