Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 3:48 pm

পরিকল্পিত নদী খননে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

আজিজ ওয়েসি : গৃহস্থের টিনের চালে আর পাহাড়ি ঢালে সারাদিন সারারাত টপাটপ বৃষ্টির ফোঁটা এক অনুভূতির নাম। কিন্তু এর বাইরেও যে আছে ভিন্ন রূপ। হাওরাঞ্চলের মানুষের কান্না। যেন সমস্ত বৃষ্টির ফোঁটা তাদের চোখের জল। বন্যা বর্ষাকালের একটা প্রাত্যহিক ঘটনা। কিন্তু যখন তা জীবন-মানের অন্তরায় হয়ে ধারায় তখনই হাহাকার আর রোনাজারি শুরু হয়। বন্যাকবলিত অঞ্চলের বাসিন্দারা তখন নিয়মিত খাবার খেতে পারে না। হাটবাজারে যেতে পারে না। রাতে ঘুমাতে পারে না। বাড়িতে পানি ওঠে গেলে ঘরে চং বা বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে ঘুমাতে হয়। অনেক সময় ঘরবাড়ি পানির নিচে চলে যায়। তখন গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ গৃহপালিত পশু-পাখির জীবননাশ হয়। অনেক সময় মানুষেরও মৃত্যু হয়। সর্বোপরি মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষতিসহ প্রায় সব ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রতি বছর এমনই ঘটে বাংলাদেশের সিলেট-সুনামগঞ্জ জেলায়। সিলেট-সুনামগঞ্জ জেলা প্রতি বছরই ছোট-বড় বন্যার সম্মুখীন হয়। কখনও বড় বন্যা, কখনও ছোট বন্যা। ফলে পুরো দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ পর্যন্ত যেসব বন্যা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা হলো ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭, ২০২২ সালের বন্যা। সম্প্রতি ২০২২ সালের বন্যা এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সিলেট-সুনামগঞ্জে এ বন্যার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। নদীমাতৃক এই দেশে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক শহর। সিলেটের সুরমা, হবিগঞ্জের খোয়াই, সুনামগঞ্জের কালনী, মৌলভীবাজারের মনুসহ সিলেট বিভাগে শতাধিক ছোট বদর অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু দখল, দূষণ ও পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলি মাটিতে নদীর উৎসমুখ ভরাট হওয়ার কারণে অর্ধেকে নেমে এসেছে। সিলেট বিভাগের প্রধান নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ খোয়াই, মনু, ধলাই, পিয়াইন, সারি, সুতাং, রতœা, সোনাই, করাঙ্গী, ঝিংড়ি, ভেড়ামোহনা, রক্তি, কালনী, বৌলাইসহ বেশকিছু নদ-নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। এতে ভাটির জনপদে নৌপথ বন্ধ, চাষবাসে সংকটসহ ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন এসব অঞ্চল। এভাবে নদী হারাচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। নদীর পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভাটির জনপদের এ নদীগুলো। তীরবর্তী জনপদের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। হ্রাস পাচ্ছে মাছের উৎপাদন। নদীগুলোর নাব্যতা হারিয়ে ব্যাপক হচ্ছে নদীভাঙন।  অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সুরমা ও কুশিয়ারা এখন যৌবনহারা। ভাঙনের কবলে বদলে গেছে এসব অঞ্চলের মানচিত্র। সিলেট ও সুনামগঞ্জের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ৩০টি ছোট-বড় নদী এবং মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই এবং হবিগঞ্জের খোয়াইসহ ২৩টি নদ-নদীই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রে দেখা যায়, এক সময় বরাক নদী হয়ে আসা পানির ৬০ শতাংশ কুশিয়ারায় এবং বাকি ৪০ শতাংশ সুরমা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু উৎসস্থল অমলসিদ থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত সুরমার যাত্রাপথে স্থানে স্থানে চর জেগে ওঠায় এখন ৮০ শতাংশ পানিই যাচ্ছে কুশিয়ারায়। অন্যদিকে ২০ শতাংশ পানি নিয়ে সুরমা ক্রমেই রূপ নিচ্ছে মরা নদীতে। সিলেটে পানির বড় উৎস এ সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। এ দুই নদীর নাব্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে অন্যান্য নদী এবং খালের মাছ ও জলজ উদ্ভিদও মরে যাচ্ছে। ২১৭ মাইল দীর্ঘ সুরমা নদী বিভিন্ন স্থান এখন ভরাট হয়ে পড়েছে। এক সময় এসব নদী দিয়ে চলাচল করত পণ্যবাহী জাহাজ, যা এখন কল্পনাও করা যায় না। নৌকা চালালেও আটকে যায় বিভিন্ন স্থানে।

আগের দিনে পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঘন বৃক্ষ-লতা-গুল্মে পানি আটকে থাকত। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামত পানি। এতে মাটির ক্ষয় হতো না। এখন বৃষ্টির পানির সঙ্গে উদাম কিংবা ন্যাড়া পাহাড় ধুয়ে লাখ লাখ টন বালি এসে নদীর তলদেশে ভরাট হচ্ছে।

সম্প্রতি এই ভরাটের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বালি ও মাটি শুধু নদ-নদীর তলদেশ নয় উৎসমুখও ভরাট করছে। যার ফলে ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে মাও সাংসাং থেকে উৎপন্ন বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প এসে মেঘালয়ের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে ওপরে উঠে যায়। এই জলীয়বাষ্প ঘন হয়ে মেঘে পরিণত হয়। যা ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে। আর মেঘালয়ের সঙ্গে সিলেট-সুনামগঞ্জের নদীগুলোর রয়েছে সরাসরি সংযোগ। ফলে একনাগাড়ে  বৃষ্টির এই পানি পাহাড়ি ঢাল বেয়ে এসব নদীতে এসে পড়ে। নদীর নাব্যতা না থাকায় বৃষ্টির পানি অল্পতেই ফুলে ওঠে, যা বন্যার সৃষ্টি করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হলে অনেক বেশি গভীর বৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভারতের মেঘালয়ে যখন বৃষ্টি হয়, তখন তা মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জে নদীতে এসে পড়ে। নদীর নাব্যতা আর বিভিন্ন বাঁধের কারণে তখন তৎক্ষণাৎ বন্যার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি সিলেট-সুনামগঞ্জে আগে এত রাস্তাঘাট ছিল না। এত স্থাপনা ছিল না। ফলে বন্যার পানি দ্রুত সরে যেতে পারত। আগে জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারত। কিন্তু এখন তা হয় না। হাওরের বিভিন্ন জায়গায় এখন ছোট ছোট সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।  শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর নিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা বেড়েই চলছে। অপরিকল্পিতভাবে এ রাস্তা তৈরির কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া বন্যার অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়ে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জ নয় কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, লালমনিরহাটসহ দেশের ১৭টি জেলায় এই ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে নদীর নাব্য হ্রাস, অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট, হাওরের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ, নদীতে বর্জ্য-আবর্জনা ফেলে নাব্যতা হ্রাস প্রভৃতি কারণে।

ফলে এসব হাওর ও নদী অঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এতে গৃহপালিত পশু পাখি মারা যাচ্ছে। এদের মরদেহ পচে দুর্গন্ধে পরিবেশ নষ্ট করছে। বন্যার ফলে অহরহ নদীভাঙন হচ্ছে। ঘরবাড়ি হারাচ্ছে এসব নদী-বিধৌত অঞ্চলের বাসিন্দারা। প্রাণ যাচ্ছে শিশুসহ সাঁতার না জানা সবার। এতে শুধু বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা দুর্ভোগে পড়েছে তা নয়, পুরো দেশের ওপর সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে। সারা দেশ থেকে মানুষ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সাহায্যের জন্য এলেও সবার মধ্যে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা কাজ করে। কৃষকরা তাদের জমি হারাচ্ছে। সময়মতো ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো পৃথিবীতে। ভয়াবহ এ বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে নদী খনন জরুরি হয়ে পড়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীকে বাঁচাতে হলে বর্জ্য শোধনাগার তৈরি করতে হবে। নদীর দু’পাশের ব্যাপক বৃক্ষায়ন ও নদী খনন জরুরি। সিলেট বিভাগের ৫৩টি নদীর পানিপ্রবাহ নির্ভর করে সুরমা-কুশিয়ারার বেঁচে থাকার ওপর। সিলেট বিভাগের নদীগুলো রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কারণ নদী না বাঁচলে বাঁচবে না মৎস্য প্রজাতি, বাঁচবে না হাওরবাসী, বাঁচবে না পরিবেশ, বাঁচবে  না দেশ, বাঁচবে না পৃথিবী। সর্বোপরি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, হাওরবাসী এবং দেশ ও মানবসভ্যতাকে রক্ষা করতে নদী খনন সময়ের দাবি।

শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়