Print Date & Time : 10 July 2025 Thursday 12:49 am

পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনকারীদের প্রণোদনা দিতে হবে

অমৃত চিছাম : সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। হাজার বছর আগে পিরামিড, ইনকা সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা সবই নির্মাণশিল্পের এক একটি অনন্য উৎকর্ষের উদাহরণ। সেই আদিম গুহাবাস থেকে শুরু করে মানবসমাজ যখন জনপদ বসতি স্থাপন করে, ঠিক তখন ধাপে ধাপে শুরু হয় টেকসই বসতি স্থাপনের জন্য আধুনিক নির্মাণসামগ্রীর প্রচলন। বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে নির্মাণশিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগ। শহরায়ন ও টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। নির্মাণশিল্প এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, নির্মাণের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে সিমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিমেন্ট ভালো না হলে বিল্ডিং মজবুত হবে না। কারণ বিল্ডিংয়ের অন্যান্য উপাদানগুলোকে সমন্বিত রাখার কাজ করে সিমেন্ট। রানা প্লাজাসহ বেশকিছু ভবন নির্মাণ ত্রুটির কারণে ধসে পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। আমরা অনুসন্ধানের সময় দেখেছি, নির্মাণ ত্রুটির অন্যতম একটি দিক ছিল সিমেন্টের সঠিক ব্যবহার না করা। ভূতাত্ত্বিকরা বলে থাকেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশকিছু এলাকা ভূমিকম্পপ্রবণ। এখন ভূমিকম্প ছাড়াই বিল্ডিং ধসে পড়ছে। তাহলে অধিক শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানীর বিল্ডিংগুলোর কী অবস্থা হতে পারে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। অবকাঠামো নির্মাণ প্রসঙ্গও এর বাইরে নয় বলে আমার মনে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ কৌশল গভীর ভূমিকা রাখতে পারে। অবকাঠামো পরিবেশবান্ধব তখনই হবে, যখন টেকসই নির্মাণ পদ্ধতির পাশাপাশি নির্মাণ টকসই হবে। এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে, যা অধিকতর কম কার্বন নিঃসরণ করবে। যার মূলে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে সিমেন্টশিল্প। সিমেন্ট একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিল্ডিং তৈরির সামগ্রী, যাতে ঈধ ও অষ-এর কতকগুলো অনার্দ্র দ্বি-সিলিকেট বর্তমান থাকে। এগুলো পরবর্তী সময়ে পানির সংস্পর্শে এসে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জমাট বেঁধে শক্ত পিণ্ডে পরিবর্তিত হয়। পানির উপস্থিতিতে বালি, পাথরের টুকরা বা ইটের মাঝে অবস্থান করে তাদের সংযুক্ত করে একটি অতিশক্ত পিণ্ডে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। বিজ্ঞানীদের মতে, ক্লিংকার তৈরি থেকে শুরু করে সিমেন্ট বা কংক্রিট তৈরির এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। কংক্রিট যে পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমন করে তার অর্ধেক নিঃসরিত হয় সিমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের প্রক্রিয়ায় আর বাকি অর্ধেক হয় জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালিয়ে ক্লিংকার উৎপাদনের মাধ্যমে। যার ফলে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে আগের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। বর্তমান সময়ে মনুষ্যসৃষ্টগ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। যেটি কিনা কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়ক, একইসঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাবক হিসেবেও কাজ করেছে। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। সারা বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের জন্য সিমেন্ট খাতের দায় ৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরাই হবো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। বর্তমানে দেশে সক্রিয় ছোট-বড় ৪২ সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। বিশ্বে নির্মাণ খাতে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘গ্রিন-সিমেন্ট’ এই কংক্রিটের জন্য সিমেন্ট ক্লিংকার কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল যেমন: সø্যাগ এবং লাইমস্টোন বেশি দিয়ে উৎপাদন করা হয়। তা ছাড়া গ্রিন সিমেন্টে খুব কম পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, যাতে ন্যূনতম কার্বন নিঃসরণ হয়। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিবেচিত বিকল্প কাঁচামালগুলো বিভিন্ন ভারী শিল্প যেমনÑস্টিল মিল এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। কাজেই এরকম কয়েকটি কাঁচামাল বিবেচনায় নেয়া যায়; যেমনÑকয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া ফ্লাইঅ্যাশের ব্যবহার বাড়ানো, স্টিলশিল্পের অ-লৌহ উপাদান সø্যাগের ব্যবহার বাড়ানো, ফাইবার গ্লাস বা গ্লাসের বর্জ্য, ধান থেকে তৈরি হওয়া ছাই, পোড়া মাটি। বেশিরভাগ শিল্পে পণ্য তৈরির জন্য গরম ভাটাগুলো ব্যবহƒত হয়। এসব ভাটায় পণ্য ঢালাই করা হয়। স্টিল থেকে শুরু করে অন্য শিল্পগুলোতে এরকম হয়। ভাটায় সø্যাগের ব্যবহার সাধারণত সবুজ সিমেন্ট তৈরির জন্য করা হয়। এছাড়া সবুজ সিমেন্ট তৈরিতে ফ্লাই অ্যাশও ব্যবহার করা হয়। এই দুটি পদার্থই দূষণের প্রধান কারণ। তাই ওই সিমেন্ট তৈরির প্রক্রিয়াটি একটি কার্বন-নেতিবাচক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার মাধ্যমে সিমেন্ট তৈরি হয়। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচও কমে, একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধবও হয়ে থাকে। যদিও ওই প্রক্রিয়ায় কার্বন উৎপন্ন হয়, তবে খুব সামান্যই। জে কে সিমেন্টের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে এই সিমেন্টের গ্রিপ খুব মজবুত হয় এবং এটি অধিক দীর্ঘস্থায়ী। এটি সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে ৪ গুণ বেশি জং প্রতিরোধী। এটি বড় নির্মাণগুলোর জন্য উত্তম হয়। কারণ এতে ক্যালসিফাইড কাদামাটি এবং চুনাপাথর মিশ্রিত করা হয়। এই উপাদানগুলো ছিদ্র কমাতে সাহায্য করে এবং এর শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ‘গ্রিন সিমেন্ট’ সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এটি ভবিষ্যতে, বর্তমান সিমেন্টের একটি উত্তম বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হবে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ক্লিংকার যেহেতু পুরোপুরি আমদানিনির্ভর কাজেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। ওই পদ্ধতি প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অধিক কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। দেশে ঘরবাড়ি নির্মাণে কম ফ্লাইঅ্যাশ এবং বেশি ক্লিংকারের সিমেন্টের প্রতি ক্রেতাদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তাদের অনেকের ধারণা ফ্লাইঅ্যাশ দিয়ে তৈরি সিমেন্টে স্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাদের এ ধারণা পুরোপুরি অযৌক্তিক। তাদের মধ্যে ভুল ধারণা এই যে, এটা ‘গ্রিন সিমেন্ট’ আজও টেকসই কি না? এ ধারণাটি বদলাতে হবে। তাদের জানাতে হবে গ্রিন সিমেন্ট বিল্ডিংয়ে ব্যবহারযোগ্য জায়গা বেশি থাকে, স্থাপনা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, আগুনের বা সূর্যের তাপ শোষণ ক্ষমতা বেশি থাকে। সর্বোপরি, গ্রিন কংক্রিটের ভবন লবণসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক দ্রব্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়। বিশেষ করে সমুদ্র তীরবর্তীস্থানগুলোতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিকে ক্ষতিকর লবণমিশ্রিত জলীয় দ্রবণের হাত থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত শোষণ বিশ্বে একটি সংকট তৈরি করেছে, যা সবার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এমন পরিস্থিতিতে সিমেন্ট কোম্পানির বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের দল সবুজ সিমেন্টের রূপে একটি ভালো ফর্মুলা নিয়ে এসেছে। এই সিমেন্ট নির্মাণে ব্যয় কম হয় ও এটি ইকোফ্রেন্ডলি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই করতে হলে শক্তিশালী অবকাঠামো বিনির্মাণ এবং সব ধরনের কাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও টেকসই শিল্পায়নকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা-২০৩০-এর অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৯ (এসডিজি-৯)। টেকসই উন্নয়নের জন্য অভীষ্ট-৯ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চিহ্নিত করেছে; যথাÑস্থিতিস্থাপক বা অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়ন এবং গবেষণা ও উদ্ভাবন। এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একজন শক্ত অংশীজন হিসেবে বাংলাদেশ অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো বিনির্মাণ ও টেকসই শিল্পায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতি প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অধিক কার্যকর, একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব। বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশও পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন একটি দেশ। তাই পরিবেশের এই বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশেও পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে; যা অর্থনীতি, জলবায়ু, মানবস্বাস্থ্য তথা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কাজেই সরকারি ও বেসরকারিভাবে ক্লিংকারের পরিমাণ কমিয়ে বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহার, গ্রিন কংক্রিট বা গ্রিন বিল্ডিংকে উৎসাহিত করা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী উৎপাদকদের প্রণোদনা দেওয়া এবং নির্মাণকারীদের পরিবেশের বিষয়ে আরও সচেতন করার মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের উচিত এখনই কাজ শুরু করা; যার ফলে দেশীয় সিমেন্ট উৎপাদন বা কংক্রিট শিল্পে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা যাবে। অন্যথায় উন্নত দেশগুলো একসময় কার্বন নিঃসরণ তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দায় আমাদের ওপরও চাপাবে এবং জলবায়ু সম্পর্কিত সাহায্য সহযোগিতাও কমে যাবে। আশা করি, সরকার ও উদ্যোক্তারা এ ব্যাপারে আরও উত্তরোত্তর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পরিশেষে আবারও ‘গ্রিন সিমেন্ট’ ব্যবহার প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে নগর পর্যায়েও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করতে হবে। জনগণকে আরও বেশি বেশি সবুজ সিমেন্ট ব্যবহারের প্রতি উৎসাহী করে তুলতে হবে। এতে করে দেশে আরও প্রচুর পরিমাণে পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট তৈরির কারখানা গড়ে উঠবে। ফলে এক দিকে যেমন ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হবে। তাছাড়া দেশে পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট তৈরির কারখানা গড়ে উঠলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর ও সর্বোপরি লিঙ্গ সমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; যা রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে।

শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ