পরিবেশ দূষণ রোধে সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে

মো. মিঠুন: ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং সুবিধা দিতে গিয়ে হেঁটে যাতায়াত ও সামাজিকীকরণের সুযোগ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু জ্বালানি অপচয় নয়, ব্যক্তিগত গাড়ির অধিক ব্যবহারের ফলে যানজট, শব্দ ও বায়ুদূষণ, দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পায়। অধিক জ্বালানি খরচের মাধ্যমে নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের আশঙ্কাও বেড়েই চলেছে। এছাড়া ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধির ফলে দেশের জ্বালানি সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

তবে এই সংকটের এখানেই শেষ নয়। অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটের ফলে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বাড়ছে, যার প্রভাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে জনজীবনে। বাংলাদেশেও এ পরিস্থিতির ব্যতিক্রম নয়।

একটি নির্দিষ্ট এলাকার ২০-২৫ বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলা হয়। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে বর্তমানে অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রিন হাউস গ্যাস (কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড) নির্গমনের ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নামে পরিচিত। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ গ্যাস, তেল ও কয়লা, অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, নদীভাঙন, খরা ও অতি বন্যা প্রভৃতি সবগুলো দিক দিয়েই বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও জলবায়ু বিপর্যয় একটি বৈশ্বিক বিষয়, কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর কারণে এ দেশের মানুষ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে আবাদি শস্যÑ ধান, গম, ভুট্টাসহ ক্ষেতের ফসল। ফলে কৃষকরা অপরিসীম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। অনেক প্রজাতির কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে। ফলে পরাগায়ন না হওয়ায় ফুল ও ফলের উৎপাদন কমে গিয়ে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ইতোমধ্যে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলীন হয়ে গেছে। জলবায়ুর বিপর্যয়ের কারণে হিমালয় এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বিপুল বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। প্রতি বছর শুধু নদীভাঙনের ফলে ২০ হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত কয়েক বছরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষত নিয়ে এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে বাংলাদেশের বিপুল উপকূলীয় মানুষ। অতিখরা ও অতিবন্যার কারণে খাদ্য উৎপাদন অনেক গুণ কমে যাচ্ছে।

মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ১৯৯০ সালে দেশে লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর, আর এখন লবণাক্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৩৫ লাখ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সুপেয় পানির অভাব, মাছ ও কৃষি উৎপাদন হ্রাস প্রভৃতি সমস্যা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করতে না পারলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩-৮ ফুট পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। তখন লবণাক্ততার পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের স্থল ভাগের প্রায় ২০ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে গবেষকরা মতপ্রকাশ করেন। জলবায়ু দুর্যোগ ফলে বাংলাদেশে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে ১ কোটি ৯৪ লাখ শিশুর প্রাণ হুমকির মধ্যে রয়েছে। গবেষকদের মতে ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্থলভূমি পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বিশেষ করে রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের বিষয়টি বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাকে অবহেলা করা। অতীতে মানুষ যাতায়াতের জন্য হেঁটে চলাচলের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বর্তমান পৃথিবীতে এমন একটি যাতায়াত ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে হাঁটা দূরত্বেও মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। বিশেষ করে নগরাঞ্চলে এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি লক্ষ করা যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি চালনার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহƒত হয়। যা অতি মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করে। আমরা জানি, বিশ্বে যানবাহন খাত থেকে ২৫ শতাংশ কার্বন নির্গমন হয়। প্রাইভেট কারের বৃদ্ধিই কার্বন নির্গমন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করছে। যা জলবায়ু বিপর্যয় বৃদ্ধির একটি মুখ্য কারণ। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কার্বন নির্গমনের মাত্রা বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে ঠিক তেমনিভাবে জ্বালানি সংকটও কমিয়ে আনা সম্ভব। এর ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারও কমে আসবে এবং পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা পাবে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের অস্তিত্ব আজ চরম সংকটে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে হলে এখনই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যক্তিগতভাবে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি সমষ্টিগতভাবে তা প্রতিরোধে জলবায়ু বিপর্যয় রোধে কাজ করতে হবে।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মূল কথাটি হলো, ‘মানুষ প্রকৃতির অংশ, তবে প্রভু নয়’। প্রকৃতির কোনো অংশকে ক্ষতি না করে বরং সহাবস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব রোধে সর্বপ্রথম মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ২০৩০ সালের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং কয়লা, গ্যাস ও তেলের (যেমন: ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলের) ওপর নির্ভরতা অর্ধেকে কমিয়ে আনা। ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে এর বিকল্প স্বরূপ গণপরিবহন (যেমন: রেল, বাস, ট্রাম ইত্যাদি) নিশ্চিতকরণ এবং পাশাপাশি অযান্ত্রিক যানবাহনের (যেমন: রিকশা, বাইসাইকেল ইত্যাদি) ব্যবহার বৃদ্ধি। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বন্ধে আইন ও নীতিমালা তৈরি। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ/বন্ধ করা এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বন জাতীয় গ্যাস নিঃসরণকারী যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উচ্চহারে কর আরোপ এবং নীতিমালা তৈরি করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন: বায়ুশক্তি, সমুদ্রসে াত ও সৌরশক্তি নির্ভর যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করা। সরকার বায়ুদূষণ হ্রাসে যেভাবে টু-স্ট্রোক যানবাহন নিষিদ্ধ করেছিল, ঠিক তেমনি জলবায়ুর বিপর্যয় মোকাবিলায়/প্রতিরোধে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

উন্নয়ন কর্মী

mithun.00714@gmail.com