রিয়াজুল হক : এক বন্ধুর সাথে অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের অবদান নিয়ে কথা হচ্ছিল। বিভিন্ন দেশের জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান কেমন, সেগুলোর কিছু উদাহরণ তিনি দিলেন। সবশেষে তার কথা ছিল, মালদ্বীপ যদি পারে, তাহলে আমাদের এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন পারছি না?
পর্যটন খাত একটি অদৃশ্য রপ্তানি শিল্প। পর্যটন এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ না করেই বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্পটগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাত থেকে বিপুল আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের জন্য ছোট এই দেশে রয়েছে শত শত মনোরম আকর্ষনীয় স্থান ও সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনসমূহঃ লালবাগ কেল্লা, মুঘল ঈদগাহ, আহসান মঞ্জিল, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁও, উয়ারী বটেশ্বর, ময়নামতি, পাহাড়পুর, কান্তজীড় মন্দির, মহাস্থানগড়।
সমুদ্র সৈকতঃ কক্সবাজার, পতেঙ্গা, পারকী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, কটকা।
পাহাড় ও দ্বীপঃ রাঙামাটি হ্রদ জেলা, কাপ্তাই হ্রদ শহর, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, মহেশখালী দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ।
ঐতিহাসিক স্থানমূহঃ জাতির পিতার সমাধিসৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ, জাতীয় কবির সমাধিসৌধ, কার্জন হল, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, বাহাদুর শাহ পার্ক, দীঘাপতিয়া রাজবাড়ি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবরস্থান, শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সাগরদাড়ি, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, ত্রিশাল, গান্ধী আশ্রম।
বন ও জলাবনঃ সুন্দরবন, রাতারগুল জলাবন।
অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থানসমূহঃ জাতীয় সংসদ ভবন, বঙ্গভবন, শাঁখারি বাজার, সদরঘাট, রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, জাতীয় চিড়িয়াখানা, জাতীয় উদ্যান, বাটালী পাহাড়, যমুনা ব্রীজ, মাধবকুন্ডু, জাফলং।
পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রথমেই আমাদের পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। কক্সবাজার পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কিংবা ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। পৃথিবীর কাছে আমাদের খাবার, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে আধুনিক ও চিত্তবিনোদনের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে হবে। অন্যথায় তারা আসবে না।
পর্যটন খাতে বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় কোন অংশেই কম লাভজনক নয়, বরং কোন কোন দেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অধিক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটন শিল্পের প্রসারের ফলে জাতীয় আয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব। দেশের যেসব অঞ্চল সাধারণভাবে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের জন্য উপযুক্ত নয়, সেসব অঞ্চলে পর্যটন শিল্প প্রসারের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও উন্নয়নের ধারাপ্রবাহে সামাজিক সমতা সৃষ্টি সম্ভব। বেকারত্বের হার হ্রাস পাবে। পর্যটন খাতে উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য শিল্পের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এর বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটা পূরণ করা সম্ভব। পর্যটন প্রসারের উদ্দেশ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণের ফলে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এই শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে।
পর্যটন শিল্পকে অর্থনৈতিকভাবে অনুকূল করতে হলে কিছু পদক্ষেপ দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এ শিল্পের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক বিষয়, যেমন- বিদ্যুৎ, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নতমানের করতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের সমুদ্র সৈকত, রাঙ্গামাটির সুভলং ঝরনা এবং বান্দরবানের শৈলপ্রপাত ও বগা লেক তথা সর্বত্র পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে হবে। পর্যটন এলাকা জুড়ে সব সময় লোকজ সংস্কৃতি মেলা ও উৎসবের আয়োজন রাখতে হবে। সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধমূলক পরিবেশবান্ধব পর্যটন সেবা সৃষ্টি করা, যা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের একমাত্র লক্ষ্যই হলো বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা সকলেই চাই সেই লক্ষ্য দ্রুত অর্জিত হোক। পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাক আরো অনেক দূরের গন্তব্যে। কারণ পর্যটন খাতের এগিয়ে যাওয়ার সাথে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। আর সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হলে, পর্যটনে মালদ্বীপের মত আমরাও এগিয়ে যেতে পারব।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক