পাঁচ মাসে ‘অব্যাহতি’র পেটে ২৯ হাজার কোটি টাকা

রহমত রহমান: কখনও উন্নয়ন প্রকল্পে, কখনও পণ্য আমদানিতে বন্ধ নেই রাজস্ব অব্যাহতি। অব্যাহতি দেয়ার ফলে চাপে পড়ছে রাজস্ব আদায়। তবে বেশি প্রভাব পড়ছে আমদানির ক্ষেত্রে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানি করা পণ্য ও যন্ত্রাংশে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অব্যাহতির লাগাম না টানলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শুল্ককর ক্ষেত্রে রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়কালে যে পণ্য আমদানি হয়েছে, তাতে অব্যাহতি দেয়া রাজস্বের পরিমাণ ২১ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ২১০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব কমেছে, শতকরা হিসাবে যা ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এনবিআর বিভিন্ন সময় প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে এ অব্যাহতি দিয়েছে।

এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এনবিআরের বিভিন্ন সময় জারি করা আদেশ অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে, তাতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় আমদানি পণ্যে রাজস্ব ছিল ২১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশি আমদানি হয়েছে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ। ছয় মাসে যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি হয়েছে, তাতে অব্যাহতি দেয়া রাজস্বের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ছিল ৩ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মধ্যে অব্যাহতিপ্রাপ্ত যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে, তার মধ্যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ খাতে সর্বোচ্চ রাজস্ব ছাড় দেয়া পণ্য আমদানি হয়েছে।

আরও দেখা গেছে, গত পাঁচ মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজস্ব ছাড় দেয়া পণ্যের তালিকায় রয়েছে ভোজ্যতেল। ভোজ্যতেল আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ সময়ে যে পরিমাণ তেল আমদানি হয়েছে, তাতে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল ৪ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা; যা গত অর্থবছর একই সময় ছিল ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ শুল্ককর ছাড় দেয়া পণ্যের তালিকায় রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমদানি

করা পণ্য। এ তালিকায় কয়েকটি বেসরকারি খাতও রয়েছে। যদিও আমদানি করা এসব পণ্যে শুল্ককর শূন্য। তবে আমদানি মূল্য হিসাব করলে এতে রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তিন হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এনবিআর বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য আমদানিতে শুল্ককর অব্যাহতি দিয়েছে। তালিকায় রয়েছেÑবিদ্যুৎ বিভাগ, পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, প্রতিরক্ষা ক্রয় অধিদপ্তর, শিপিং লাইনস ও বেসরকারি খাতের কয়েক প্রতিষ্ঠান।

এনবিআর সূত্রমতে, অব্যাহতি নেয়া সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যাতে কর ছাড় নেয়। আবার এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। অব্যাহতি দেয়া হলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অব্যাহতির লাগাম টানতে চায় এনবিআর। সে জন্য সহযোগিতা চেয়ে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের অব্যাহতি দেয়া পণ্য আমদানি কমেছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব অব্যাহতি দেয়া পণ্য আমদানি হয়েছে, তাতে আগাম কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তিন হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল তিন হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। ডিফেন্স স্টোর ছয় মাসে যে পণ্য আমদানি করেছে, তাতে রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৩০৯ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের আমদানি করা যন্ত্রাংশ ও পণ্যে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এক হাজার ৩১১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮৫৫ কোটি টাকা। মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে আমদানি করা পণ্যে ছয় মাসে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এক হাজার ২১২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল এক হাজার ২৬২ কোটি টাকা। রিলিফ গুডস বা সহায়তার পণ্য কম আমদানি হয়েছে। ফলে ছয় মাসে মাত্র ১৬২ কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল এক হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এছাড়া শিল্পের কাঁচামালে ৯০৪ কোটি টাকা, পোলট্রি ফার্মে ৩৯৭ কোটি টাকা, টেক্সটাইল খাতে ৩২৬ কোটি টাকা, বেজার ৪৬৯ কোটি টাকা, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির ২৪৮ কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। যেখানে পাঁচ মাসে ঘাটতি ছিল প্রায় ৯ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এর আগে অক্টোবর পর্যন্ত ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী, প্রথম ৬ মাসে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি বা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৭৭৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ৬ মাসে ভ্যাট খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৬ হাজার ১২৯ কোটি। ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। আমদানি-রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। আয়করে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৪৪ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, কর অব্যাহতির বিষয়ে এনবিআর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে দেখা গেছে, বিভিন্ন খাতে অব্যাহতি দেয়ায় প্রতি বছর রাজস্ব ক্ষতি হয় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ, টাকার অঙ্কে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে, কর অব্যাহতির বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘কর অব্যাহতি না দিলে আমাদের কর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৭-এর ওপরে থাকত। কর সহায়তা দেয়ার ফলে শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক খাতে আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, আমরা কর অব্যাহতি যদি না দিতাম, তাহলে আমাদের কর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছে যেত। আমরা বাজেটের আগে হিসাব করে দেখেছি, অব্যাহতি না দিলে আমাদের কর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৭-এর ওপরে থাকত। কর সহায়তা দেয়ার ফলে শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক খাতে আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। কর অব্যাহতি দেয়ার ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন, ব্যবহার ও সুযোগ তৈরি হয়েছে। গরিব জনগোষ্ঠীর পরিমাণ কম, শিক্ষার হার বেশি, মাতৃমৃত্যুহার কম।’ কর অব্যাহতি সুবিধা ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, মূলত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অব্যাহতি দেয়া হয়। প্রকল্পে অব্যাহতি দেয়ার ফলে দেশে উন্নয়ন হয়। তবে এনবিআর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে।