Print Date & Time : 28 July 2025 Monday 4:31 pm

পাবনায় বাড়ছে মহিষের খামার

প্রতিনিধি, পাবনা: তিনটি গাভি ও তিনটি বাচ্চা মহিষ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা মহিষের খামারে ভাগ্য বদলেছে পাবনার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের ভগীরথপুরের রাসেল ব্যাপারীর। দ্বিগুণ লাভে তিন বছরে তার খামারে এখন ১৫টি গাভি ও ১০টি বাচ্চা মহিষ রয়েছে। এর মাঝে প্রায় লাখ টাকা দামে বিক্রি করেছেন ৭টি মহিষের বাচ্চা। মহিষের গাড়ি চালিয়ে ও চাষ করে সংসার না চলা রাসেলের সংসারে এখন সুখের বন্যা। তাকে দেখে অনেকেই ঝুঁকছেন মহিষের এ বাণিজ্যিক খামারে।

রাসেল ব্যাপারী জানান, সবজি চাষ ও মহিষের গাড়ি চালাতেন তিনি ও তার বাবা। দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমেও সংসার চালানো দায় ছিল তাদের। পার্শ্ববর্তী জেলা নাটোরের লালপুরে মহিষের খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৯ সালে ৭ লাখ টাকায় বাচ্চাসহ ৬টি মহিষ নিয়ে শুরু করেন খামার। এখন সেটি সম্প্রসারণে ভাগ্য বদলেছে তাদের। বছরজুড়েই অন্তত ৫ থেকে ৭টি মহিষ ৩ থেকে ৪ কেজি করে দুধ দেয়। এ দিয়েই খামারের মহিষের খাবারসহ অন্যান্য ব্যয় মিটে যায়। গরু বা অন্যান্য গবাদি পশুর তুলনায় রোগবালাই ও লালনপালনে খরচ কম হওয়ায় তেমন বিনিয়োগ ছাড়াই ব্যাপক লাভে রাসেলের খামার।

রাসেল বলেন, এখন আমার খামারে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫টি মহিষ আছে। ৬টি মহিষ দুধ দিচ্ছে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ কেজি দুধ পাচ্ছি। ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিদরে এ দুধ বিক্রি হয়। একটি মহিষ গড়ে ৬ থেকে ৭ মাস দুধ দেয়। খাবারসহ গড়ে একটি মহিষের পেছনে দিনে ১০০ টাকার কম খরচ হয়। তবে আমাদের এত খরচ হয় না; কারণ বিভিন্ন মাঠের ও জমিতে লাগানো ঘাস খাওয়ানোর ফলে খরচ অনেক কম হয়। এরপর প্রতিবছর মহিষপ্রতি একটা বাচ্চা আমাদের লাভ থাকে। বাচ্চাগুলো ৮০ হাজার থেকে লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, সবজিসহ অন্যান্য চাষে সংসার চালাতে পারছিলাম না। মহিষের গাড়ি বেয়েও কূলকিনারা পাইনি। বছরে ঘর নষ্ট হলে একটা টিন লাগাতে খুব হিসাব করতে হতো। এখন এই খামার করে অভাব ঘুচেছে। জমি কিনেছি, বাড়িঘরও ঠিক করেছি।

গত এক দশকে মাংস ও দুধের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় মহিষের বাজারমূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ। বাণিজ্যিক সফলতায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে অনেকেই এখন পুরোদস্তুর খামারি। এই খামার করে শুধু রাসেল ব্যাপারী নয়, পাবনার জয়নাল প্রামাণিক, ফরিদ ও মনি ব্যাপারীসহ কয়েকটি উপজেলার অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের ভাগ্য বদলেছে। দুই থেকে তিন বছরে খামারের পরিসর বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
খামারি জয়নাল প্রামাণিক জানান, ২৬ থেকে ২৮ লাখ টাকায় ২২টি মহিষ কিনে খামার শুরু করি। লালনপালনের সময় একটি মহিষ মারা যায়। এ পর্যন্ত তিনটি মহিষ বিক্রি করেছি। তিন বছর পর এখন আমার খামারে ৪৫টি মহিষ রয়েছে। এদের দেখভালে আপাতত তিনজন রাখাল রাখা আছে। এবার এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশেই পদ্মার চর। এখান থেকে ঘাসের বড় একটি চাহিদা মিটে যায়। বাকিটা রোপণ করা ঘাস ও অল্প খৈল-ভুসিতে মেটে। সবমিলিয়ে গরু বা অন্যান্য গবাদিপশুর তুলনায় মহিষ পালনে খরচ অনেক কম।

রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, মহিষের রোগবালাই কম। তবে একেবারে হয় না, তা নয়। একটি মহিষ মারা গেলে প্রায় দেড়-দুই লাখ টাকা শেষ। এদিক থেকে সচেতন থাকতে হয়। এর পাশাপাশি সরকারি পশু চিকিৎসকরা একটু সহযোগিতা করলে ভালো হয়। কিন্তু আমরা সেটি তেমনভাবে পাই না। অধিকাংশ সময় বাইরের ডাক্তার ডেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই। বাণিজ্যিকভাবে মহিষ পালনে শুধু খামারিদের ভাগ্য বদলায়নি, সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের। অধিকাংশ বড় খামারগুলোয় দুই থেকে পাঁচজন লোক কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।
মহিষ দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাখাল সাগর বলেন, ‘সকালে দুধ দোহানো শেষে মাঠে আনি। সারাদিন মাঠে ঘাস খাওয়াই। দিনে ৪ থেকে ৫ বার নদীতে নিয়ে ডুবিয়ে (গোসল) রাখতে হয়। গরমের দিনে অর্ধেক দিন খাওয়াতে হয়, আর অর্ধেক দিন পানিতে রাখতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখন তো মহিষ পালনে খরচ নেই বললেই চলে। তবে বর্ষাকালে যখন মাঠঘাট পানির নিচে থাকে, তখন ঘাসের সংকট হয়। এ সময় উঁচু জমিতে ঘাস চাষ করে খাওয়াতে হয় এবং খৈল-ভুসিও বেশি লাগে।

জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য বলছে, ৫ বছর আগেও এ জেলায় মহিষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ হাজার। বাণিজ্যিক খামার তেমন দেখা যেত না। শুষ্ক মৌসুমে চারণভূমি, জলাধার ও গোখাদ্যের সহজলভ্যতায় জেলার চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে মহিষ পালনে আগ্রহী হচ্ছেন খামারিরা। বর্তমানে জেলায় ৬৬টি খামারে প্রায় ২২ হাজার মহিষ লালন পালন হচ্ছে। এ বছর ৬০৫টি মহিষের প্রজনন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা একেএসএম মুশারফ হোসেন বলেন, জেলার সদর, ঈশ্বরদী, সুজানগর, সাঁথিয়া, বেড়া ও চাটমোহরে বাণিজ্যিকভাবে মহিষ পালন বেশি হচ্ছে। এক্ষেত্রে গলাফুলা ও কৃমিনাশকের টিকা প্রদানসহ আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করছি। মহিষের প্রজননে প্রতি উপজেলায় একজন করে দক্ষ টেকনিশিয়ান রাখা হয়েছে। এছাড়া মাঠকর্মীদের মাধ্যমে এ খামার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত চারণভূমি থাকায় বাণিজ্যিকভাবে মহিষ পালন দ্রুত বড় ধরনের একটি সফলতা বয়ে আনবে।