শাহীন রহমান, পাবনা: অপরিকল্পিত নগরায়ণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাবনা পৌরবাসী। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অনুপাতে অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় মিলছে না নাগরিক সেবা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনে বাড়ছে ঝুঁকি, বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয়রা জানান, চলতি বছরের আগস্ট মাসে পাবনার মধ্য শহরের আবদুস সাত্তার বিশ্বাসের বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগে। এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও, সেদিন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের প্রায় ১০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। ঈদের একদিন আগে নিঃস্ব হয়ে যান এখানকার ব্যবসায়ীরা।
পরবর্তী সময়ে তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। তবে ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির জন্য তারা দায়ী করেছেন অগ্নিনির্বাপণে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকাকে। ঘটনাস্থলের আশপাশে পানির উৎস না থাকায় প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে পানির সংস্থান করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় দূরবর্তী উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে সময় বেশি লাগায় ভয়াবহ এ আগুন নেভাতে সময়ও লেগে যায় অনেক। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও দিয়েছে একই মত। তারা জানিয়েছে আরও ভয়াবহ আশঙ্কার কথা। তা হলো কেবল দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটিই নয়, দুর্বল নির্বাপণ ব্যবস্থার কারণে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে শহরের অধিকাংশ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সংকীর্ণ রাস্তার পাশে, ভবন নির্মাণ নীতিমালা না মেনে তৈরি হচ্ছে একের পর এক বহুতল ভবন। সাততলার বেশি উঁচু যে কোনো ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তোয়াক্কা করছে না কেউ। এক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পাবনার সহকারী পরিচালক কেএম সাইফুল ইসলাম জানান, আমাদের যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সবাই ফায়ার সার্ভিসকে দোষারোপ করে। কিন্তু নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন, সেটা খেয়াল করেন না। আমরা বারবার সতর্ক করছি। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই আপত্তিপত্রে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বড় বড় ভবন গড়েছেন, রাখেননি পানির রিজার্ভারও। এ অবহেলার পরিণাম যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা ধারণা করাও কঠিন। সাত্তার বিশ্বাস ভবনে তার কিছু নমুনা দেখা গেছে। বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রিজার্ভার রাখা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরোনো ২৭ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৌর এলাকায় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদায় ইট-পাথরের জঞ্জাল বাড়লেও, বাড়েনি রাস্তাঘাট, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত বহুতল বিপণিকেন্দ্র ও আবাসিক ভবনগুলোর অধিকাংশেরই নেই পার্কিং, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা।
অভিযোগ রয়েছে, সড়ক ও পয়োনিষ্কাশনের জায়গাও দখলে। গত ১০ বছরে শহরতলিতে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি চালু হয়েছে রেলপথ। বাড়তি মানুষের চাপে, অপ্রশস্ত সড়কে যানজট এখন নিয়মিত চিত্র। সামান্য বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে অধিকাংশ সড়ক। কখনও সড়ক উপচে পানি ঢুকে বাড়িঘরে। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা আবর্জনায় চরমে পৌঁছায় জনদুর্ভোগ।
১৯৮৯ সালে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হওয়া এ পৌরসভার নেই মাস্টারপ্ল্যান। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় শহর বিকেন্দ্রীকরণের তাগিদ দিয়েছেন নগরবিদরাও। এ বিষয়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোহেল রানা বলেন, পাবনা অনেক পুরোনো শহর হলেও তার কোনো আধুনিকায়ন হয়নি। সব প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ দফতর, হাসপাতাল সবকিছুই এত কাছাকাছি যেসব জায়গা থেকে মানুষ এসে একই এলাকায় ভিড় করে। এখন শহর বিকেন্দ্রীকরণ করে, আধুনিক সড়ক ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগের একটি মহাপরিকল্পনা।
মহাপরিকল্পনা না থাকার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ দায়ী করেছেন আর্থিক সংকটকে। পাবনা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তবিবুর রহমান জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পৌরসভার মহাপরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা দেয়। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। নির্দেশনা পেলে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। অপরিকল্পিত বহুতল ভবনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পৌরবাসীর সচেতনতাও প্রয়োজন।
অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন পাবনা জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, অনুমোদনহীন ভবনের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। আমরা ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে যে কোনো উদ্যোগে প্রশাসন সর্বশক্তি নিয়ে পাশে থাকবে।
ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য বাসযোগ্য শহর গড়তে দ্রুততম সময়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের দাবি পৌরবাসীর।
