Print Date & Time : 18 August 2025 Monday 1:04 am

পাবলিক পরীক্ষায় গাইড বইয়ের প্রশ্ন সৃজনশীলতা কোথায়?

 

মাছুম বিল্লাহ: বাজারি গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে ২০১৬ জেএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন করা হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় যেখানে বাজারি প্রশ্ন কিংবা গাইড বই থেকে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ, সেখানে বোর্ডের প্রশ্ন গাইড বইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আর সৃজনশীল প্রশ্ন যেখানে সব সময়ই উদ্ভাবনমূলক ও নতুন হওয়ার কথা, সেখানে এবার আগের পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিও ঘটে। মূলত এ ধরনের ঘটনা প্রতিবছরই ঘটছে এবং শুধু বাংলায় নয়, অনেক বিষয়েই ঘটে। তবে দু-এক বছর দু-একটি বিশেষ কারণে বিষয়টি ধরা পড়ে। ২০১৪ সালের শেষের দিকে এনসিটিবিতে (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) জেএসসি ও এসএসসির ইংরেজি প্রশ্নপত্র নিয়ে কয়েকটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা ছিলেন সেখানে। আমি এনজিও প্রতিনিধি হিসেবে ছিলাম সেখানে। তাদের বলেছিলাম, বোর্ডের প্রশ্ন কী পরিমাণে এবং কীভাবে রিপিট করা হয়। ২০১৩ সালে চালু হওয়া নতুন বইয়ের আগে দশম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ১১৯টি লেসন ছিল। ১১৯টি লেসনের মধ্যে আটটি শিক্ষা বোর্ডে ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ১২টি প্যাসেজ এসেছে। বাকি ১০৭টি লেসন কোনোদিন শিক্ষার্থীদের টাচ করারই দরকার হয়নি। কারণ কোনো বছরই সেগুলো থেকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। এর মধ্যে দু-একটি প্যাসেজ বিভিন্ন বোর্ডে রিপিটেশন মিলে ১৬-১৮ বারও এসেছে। দু-একটি প্যাসেজই বিভিন্ন বোর্ডে বারবার এসেছে, তবে যতগুলোই যতবারই আসুক, মাত্র ১২টি প্যাসেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য আরেকটি জাতীয় সেমিনারে সঠিক প্রমাণসহ মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। একই বিষয় এনসিটিবির ওয়ার্কশপে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তারা উত্তর দিলেন প্রশ্নও আমরা করি না, খাতাও আমরা দেখি না। শিক্ষকরাই প্রশ্ন করেন এবং তারাই খাতা মূল্যায়ন করেন। অতএব আমরা কী করতে পারি। আমি তখন বিনীতভাবে বলেছিলাম, এ কথা বলে আপনাদের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। পরীক্ষায় কীভাবে প্রশ্ন করা হয়, কোন সোর্স থেকে প্রশ্ন নেওয়া হয়, কতবার রিপিট করা হয় এ বিষয়গুলো তো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদেরই দেখতে হবে।

এ বছর ১ নভেম্বর জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। প্রথম দিনই ছিল বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা। এতে ৬০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নের প্রায় শতভাগ এবং ৪০ নম্বরের বহুনির্বাচনি প্রশ্নের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রশ্নই একটি নামকরা পাবলিকেশনের গাইড থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান গাইড থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়া ও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তির ঘটনাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ‘যেখানে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেওয়া নিষিদ্ধ, সেখানে বোর্ডের পরীক্ষায় এমন ঘটনা দুঃখজনক। এ ঘটনা সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।’ বারবার বিভিন্ন মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে আলোচিত হচ্ছে যে, বর্তমান পদ্ধতির সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষকদের বিরাট একটি অংশ তৈরি করতে পারেন না। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু তারা বিষয়টিতে খুব একটি গুরুত্ব দেয়নি। বিষয়টি বোধ হয় আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে, শিক্ষকরা নিজেরাই সৃজনশীল প্রশ্ন বোঝেন না আর বোঝেন না বলেই তারা সরাসরি গাইড বই থেকে তুলে দিয়েছেন। এটি ঘটেছে পাবলিক পরীক্ষায়। এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এসব শিক্ষক তাদের নিজস্ব বিদ্যালয়ের প্রশ্ন কীভাবে করেন। নিশ্চয়ই গাইড বই থেকে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যারা বোর্ডের প্রশ্ন করেন তারা সাধারণত নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। মফস্বলের কিংবা অখ্যাত কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বোর্ডের প্রশ্ন করতে সাধারণত দেওয়া হয় না। নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৃজনশীলতার নামে কী পড়ানো হচ্ছে আর কী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটু ভেবে দেখবে কি?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা শিক্ষা বোডের্র প্রশ্নে বাংলা প্রথম পত্রের যে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেটি প্রণয়ন করা হয়েছে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। এটিই অবশ্য নিয়ম, এক বোর্ডের প্রশ্ন অন্য আরেক বোর্ডের শিক্ষকরা করে থাকেন। বর্তমান নিয়ম অনুসারে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চার সেট করে প্রশ্ন তৈরি করা হয়। আট সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মোট ৩২ সেট প্রশ্ন থাকে, লটারির মাধ্যমে দুই সেট প্রশ্ন ছাপা হয়। এর মধ্যে এক সেট প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। একটি বিষয়ের প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে একজন প্রশ্ন প্রণেতা ও চারজন মডারেটর যুক্ত থাকেন। তবে মূল দায় প্রশ্ন প্রণেতাকেই বহন করতে হয়। আমার এ বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে আছে। আমি ক্যাডেট কলেজের চাকরি ছেড়ে যখন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে যোগদান করি, তখন কুমিল্লা বোর্ডের কোনো এক পাবলিক পরীক্ষার একটি বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়েছিল। আমি মোটামুটি শিক্ষার্থীরা যাতে নিজ থেকে লিখতে পারে সেভাবে প্রশ্ন তৈরি করেছিলাম। দেখা গেল, মডারেশনে সেসব প্রশ্ন অধিকাংশই বাদ দিয়ে একেবারে ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। আমরা যেন এতেই বেশি বিশ্বাস করি, সৃজনশীলতার কথা মুখেই বলি, কাজে নয়।

বাংলা প্রথম পত্রের সিকিউ ৬০ নম্বরের মধ্যে ৯টি উদ্দীপকসহ সংযুক্ত চারটি করে প্রশ্নমালা রয়েছে। আর এমসিকিউ অংশে রয়েছে ৪০ নম্বরের ৪০টি প্রশ্ন। প্রশ্নটি বাজারের গাইডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় যে, সিকিউয়ের আটটি প্রশ্নের উদ্দীপকসহ সংযুক্ত প্রশ্নগুলো হুবহু গাইড থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে একটি প্রশ্নের উদ্দীপক ও একটি সংযুক্ত প্রশ্ন অন্য কোথাও থেকে নেওয়া হয়েছে। সেটুকু হয়তো মডারেটরদের কাজও। এমসিকিউ অংশের ৪০টি প্রশ্নের মধ্যে ২১টি হুবহু ওই পাবলিকেশনের গাইড থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ৯টি প্রশ্নের মধ্যে চারটি প্রশ্নের

উদ্দীপক ও সংযুক্ত প্রশ্ন হুবহু আগের বিভিন্ন জেএসসি পরীক্ষায় এসেছে। প্রশ্নপত্রের এক নম্বর উদ্দীপক ও প্রশ্নমালা ২০১৪ সালের জেএসসি পরীক্ষায় বরিশাল বোর্ডে, সাত নম্বর উদ্দীপক ও প্রশ্নমালা ২০১৩ সালের জেএসসিতে সব বোর্ডে, আট নম্বর উদ্দীপক একই সালের ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষায় এসেছিল। এভাবে প্রশ্ন রিপিট করে সৃজনশীলতার নামে আসলে হচ্ছেটা কী?

সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ানো এবং মুখস্থবিদ্যা ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমানো। এ কারণে পাঠ্যবইয়ে প্রশ্ন দেওয়া থাকে না। যে নমুনা প্রশ্ন থাকে, তাও তুলে দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উদ্ভাবন করতে হয়। এ কারণে এক পরীক্ষার প্রশ্ন আগের কোনো পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলবে না। কোনো গাইড বই থেকেও প্রশ্ন কমন পড়বে না। কিন্তু এবার বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্র এবং বাজারের একটি গাইড মিলিয়ে দেখা গেল, প্রশ্নগুলো হুবহু গাইড থেকে নেওয়া। বর্তমানে প্রচলিত সৃজনশীল প্রশ্নে উদ্দীপক থাকে, প্রশ্ন প্রণেতাকে উদ্দীপক বানাতে হয়, কিন্তু তারা তো বানাতে পারছেন না। কোনো কোনো স্টাডি বলছে, ৫১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না, আবার কেউ বলছেন, ৪৫ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। অর্থাৎ বাকিরা পারেন। এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি

বললেন, কিসের ৫১ আর ৪৫ শতাংশ, ৯৮-৯৯ শতাংশ শিক্ষকই বিষয়টি বোঝেন না। আসলে ওনার কথাই বোধ হয় ঠিক, তা না হলে পাবলিক পরীক্ষার প্র্রশ্নে হুবহু গাইডের প্রশ্ন থাকবে কেন? বর্তমান সৃজনশীল প্রশ্ন তো আসলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন। তাই উদ্দীপক ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার কথা চিন্তা করতে হবে।

দেশের শিক্ষাবিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কোনো স্টাডি বা গবেষণার ফল উপস্থাপন বিষয়টির সঙ্গে যারা জড়িত, যারা এ নিয়ে কাজ করেন, চিন্তাভাবনা করেন, মতামত প্রকাশ করেন তাদের সাধারণত আহ্বান জানানো হয় না। আমন্ত্রণ জানানো হয় অনেক উঁচু লেভেলের কিংবা নামকরা ব্যক্তিদের যারা সমস্যার মূলের বিষয়ের সঙ্গে হয়তো সম্পৃক্ত নন। আসল সমাধান যারা দিতে পারেন তাদের ডাকা হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই তার ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় দেখিয়েছেন কীভাবে একজন সাধারণ ও অবহেলিত মুচি রাজার পা’কে ধুলাবালি থেকে রক্ষার জন্য অল্পতেই সমাধান দিতে পারেন, যা দেশের অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি বহু সভা-সেমিনার ও অর্থব্যয় করেও সমাধানের ধারেকাছে যেতে পারেননি। এখানেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু আমরা শিখব কি?

 

ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক

masumbillah65Ñgmail.com