নিজস্ব প্রতিবেদক: পায়রা বন্দর নিয়ে নানা সংশয় ব্যবসায়ীদের মনে। বড় জাহাজ ঠিকমতো ভিড়তে পারবে কি না, সেখান থেকে মালামাল ছোট জাহাজে করে অন্য জায়গায় নেয়ার নাব্য থাকবে কি না। আবার আন্ধারমানিক সেতু না হওয়ায় সড়কপথেও সমস্যা, পলি পড়ে বন্দরের চ্যানেল ভরাট হবে কি না, বন্দরেই বা ঘুষ ছাড়া কি সেবা মিলবে এমন নানা প্রশ্নের উত্তরে তাদের অভয় দিলেন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।
তিনি বলেন, ‘পায়রা হচ্ছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্মিত প্রথম বন্দর। এখানে একদল তরুণ উদ্যম নিয়ে কাজে যুক্ত হয়েছেন। এটা হচ্ছে স্মার্ট পোর্ট, এখানে সবই হবে অটোমেটেড। ৩ মার্চ পায়রায় ভিড়ছে ৩৫ হাজার টনের জাহাজ। আপনারাও নির্দ্বিধায় এই বন্দরে জাহাজ আনান, একবার দেখে যান আমাদের সার্ভিস।’
গতকাল সোমবার রাজধানীর বিআইডব্লিউটিএ ভবনের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে ‘পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দরের অংশীজনের মধ্যে মতবিনিময়’ সভায় ব্যবসায়ীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন বন্দরের চেয়ারম্যান। এতে বন্দর কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশের জাহাজ খাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বক্তব্য দেন। সভার শুরুতে পাওয়ার পয়েন্টে তথ্য উপস্থাপন করেন বন্দরের কর্মকর্তারা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক অপারেশন শুরুর পর পায়রা বন্দর এখন পর্যন্ত মোট ২৬৯টি বিদেশি জাহাজ এবং এক হাজার ৫৩টি লাইটার জাহাজের মোট ৮৭ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডেল করেছে। এ থেকে সরকার ৮০০ কোটি টাকা আয় করেছে।
এর মধ্যে প্রথম বছর ২০১৯ সালে বিদেশি জাহাজের সংখ্যা ছিল ২২টি, যেখানে ২০২২ সালে বন্দরে ভিড়েছে ১২১টি বিদেশি জাহাজ। পায়রার বহির্নোঙরে পণ্য আনা-নেয়া চট্টগ্রাম ও মোংলার চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী বলেও জানালেন কর্মকর্তারা।
উদাহরণ দিয়ে উপস্থাপনায় বলা হয়, পায়রা দিয়ে ৩০ হাজার টন পণ্য আনা-নেয়া করলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা এবং মোংলার চেয়ে প্রায় ২৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
অপরদিকে পায়রার অভ্যন্তরীণ নোঙরে (ইনার অ্যাংকোরেজে) পণ্য আনা-নেয়ায় মোংলার চেয়ে ২৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দরে ইনার অ্যাংকোরেজে পণ্য খালাস হয় না, সেখানে জাহাজ থেকে জাহাজে পণ্য নামানো হয়।
পায়রায় গাড়ি খালাস করলে সেটাও চট্টগ্রাম ও মোংলার চেয়ে সাশ্রয়ী বলে দাবি কর্মকর্তাদের। সড়ক ও নৌপথে এ বন্দর ঢাকার সবচেয়ে কাছে। অচিরে এ বন্দরে যুক্ত হচ্ছে রেল।
অংশীজনদের আলোচনা পর্বে বাংলাদেশ শিপার্স কাউন্সিলের পরিচালক সৈয়দ মো. বখতিয়ার বলেন, ‘মোংলা একসময় করাপশনে তুঙ্গে ছিল। কাস্টমস আর বন্দর কর্মকর্তাদের অত্যাচারে সেখানে ব্যবসায়ীরা কেউ যেত না। মোংলা বন্দরের কার্যক্রম একসময় স্তিমিত হয়ে গেল। তারপরে কর্তৃপক্ষ মোংলায় গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য বিশেষ ট্যারিফ ঘোষণা করল। এরপর পুরো গাড়ি ব্যবসা মোংলায় শিফট করল।’
‘এরকম হেনস্তা’ এখন চট্টগ্রাম বন্দরে হতে হয় উল্লেখ করে তার ভাষ্য, ‘মোংলার মতো এখন চট্টগ্রাম বন্দরে চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিকারকদের নাজেহাল হতে হয়। প্রত্যেকটা আমদানিকারককে আমরা মনে করি অসৎ। মনে করি যে, সে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধ মাল নিয়ে আসছে। আসলে এরকম করে এক-দুই বা তিনজন ব্যবসায়ী, সেটার জন্য আপনাদের ব্যবস্থাও আছে। আপনাদের ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস ব্যবস্থা সেখানে করতে হবে।’ পায়রা বন্দর নিয়ে নানা শঙ্কার জবাবে চেয়ারম্যান বললেন, ‘নির্দ্বিধায় জাহাজ আনুন’।
অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য দেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম সোহায়েল। তিনি ব্যবসায়ীদের সব ‘সন্দেহ’ দূরে রেখে সরেজমিনে বন্দরে আসার আহ্বান জানান।
পলি পড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের চ্যানেলও নিয়মিত মেইনটেন্যান্স করতে হয়। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। আপনারা পলির বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের ওপরেই ছেড়ে দিন, ভরসা রাখুন। এর বাইরে বন্দরমুখী নদীপথের কয়েকটি জায়গায় সমস্যা আমরাও চিহ্নিত করেছি। সেজন্য বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সামান্য ড্রেজিংয়েই সেই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে। আর আন্ধারমানিক সেতুর জয়গায় আমরা ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। পদ্মা সেতু থেকে সেখানে ফেরি যাবে। আগামী মাসেই এই সেতুর টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়তো সম্পন্ন হবে।’
চেয়ারম্যান সোহায়েল বলেন, “এই মার্চেই পায়রা বন্দরে ভিড়তে যাচ্ছে ৩৫ হাজার টনের একটি ‘প্যানামেক্স’ জাহাজ। সামনের এপ্রিলের মধ্যে পায়রার মূল চ্যানেল ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে সেটি সাড়ে ১০ মিটার গভীরতা পাচ্ছে। জোয়ারের সময় ড্রাফট দাঁড়াবে সাড়ে ১২ মিটার। আগামী মে মাসেই প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। বন্দরের ইনার চ্যানেলেই একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫টি মাদার ভেসেলের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা, কন্টিনজেন্সি অ্যাংকরেজের সুবিধাসহ আরও অনেক সুবিধা থাকবে।”