২০২২-২৩ অর্থবছর

পায়রা-রামপালের চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম আদানির!

ইসমাইল আলী: ৮ মার্চ থেকে আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। আর ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে ভারতের কোম্পানিটি। উৎপাদন শুরুর আগে থেকে আদানির বিদ্যুতের দাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। উচ্চ ব্যয়ের কারণে আপত্তি তোলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে বাধ্য হয়েই বিদ্যুতের দাম পায়রা-রামপালের চেয়ে কম রাখার প্রস্তাব দেয় আদানি পাওয়ার।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছর আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ পায়রা ও রামপালের চেয়ে অনেকটাই কম পড়েছে। পিডিবির আর্থিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর রামপালের চেয়ে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিটে ১০ পয়সা কম পড়ে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে তা কম পড়ে দুই টাকা এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় পাঁচ টাকা।

এদিকে গত বছর ডিসেম্বর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির (বিআইএফপিসিএল) রামপাল কেন্দ্রের একটি ইউনিট। ২০২০ সালের মে থেকে নিয়মিত উৎপাদন করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর চলতি বছরের ১ জানুয়ারি উৎপাদন শুরু করেছিল বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার লিমিটেডের কেন্দ্রটি। কয়লাভিত্তিক এ চার কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় বরিশাল ইলেকট্রিকের।

যদিও উৎপাদন শুরুর আগে থেকেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। কারণ এ কেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি। আদানির প্রস্তাবিত সেই দামে বিদ্যুৎ কিনতে অস্বীকৃতি জানায় পিডিবি। এ নিয়ে দুই পক্ষের চিঠি চালাচালি ও দরকষাকষির পর পায়রা-রামপালের চেয়ে কয়লার দাম কিছুটা কম রাখতে সম্মত হয় আদানি।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে পরিচালিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। কয়লা সংকটে গত অর্থবছর এর সক্ষমতার মাত্র ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। ফলে ওই কেন্দ্রটিতে ৬৯০ কোটি চার লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে সাত হাজার ৮২৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ তিন হাজার ২২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়ে ১১ হাজার ৫৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এতে পায়রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে ১৬ টাকা ০২ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ চার টাকা ৬৮ পয়সা ও গড় জ্বালানি ব্যয় ১১ টাকা ৩৪ পয়সা।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। একটি ইউনিট চালু থাকলেও কয়লা সংকটে তা চলেছে মাত্র ৩৪ শতাংশ সময়। এতে উৎপাদন হয় ১১৪ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ। গত অর্থবছর রামপালের জ্বালানি ব্যয় ছিল প্রায় এক হাজার ২৫০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও ক্যাপাসিটি চার্জ ৩৬২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়ে এক হাজার ৬১৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ টাকা ১২ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ তিন টাকা ১৮ পয়সা ও গড় জ্বালানি ব্যয় ১০ টাকা ৯৪ পয়সা।

এদিকে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। এর একটি ইউনিটের ৯০ শতাংশই ব্যবহার হয়েছে গত অর্থবছর। ফলে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হয় ১৫৯ কোটি ৮২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে আদানির জ্বালানি ব্যয় হয় এক হাজার ৪৭০ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ক্যাপাসিটি চার্জ ৬৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওঅ্যান্ডএম) ব্যয় ১৩৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন ব্যয় দুই হাজার ২৪১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ টাকা ০২ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ তিন টাকা ৯৬ পয়সা, গড় জ্বালানি ব্যয় ৯ টাকা ২০ পয়সা ও গড় ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ৮৬ পয়সা।

অন্যদিকে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০৭ মেগাওয়াট। কয়লা সংকটে এর মাত্র ৪৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন হয় ৬০ কোটি ৪১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় পড়ে ৭৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ক্যাপাসিটি চার্জ ৪০০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন ব্যয় এক হাজার ১৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১৯ টাকা ০১ পয়সা। এর মধ্যে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ছয় টাকা ৬৩ পয়সা, গড় জ্বালানি ব্যয় ১২ টাকা ১৮ পয়সা ও গড় ওঅ্যান্ডএম ব্যয় ২০ পয়সা।

জানতে চাইলে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয় পায়রার তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছিল প্রাথমিকভাবে। তবে গত ডিসেম্বরে এ নিয়ে আপত্তি তুলে চিঠি দেয়া হয়। এরপর দুই পক্ষের দরকষাকষির পর আদানি জ্বালানি তথা কয়লার দাম কম রাখতে সম্মত হয়। গত ১ জুলাই এক চিঠিতে এ প্রসঙ্গে আদানি জানায়, বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির জ্বালানি ব্যয় দশমিক শূন্য এক সেন্ট (০.০১) কম রাখা হবে। প্রতি মাসে এ দাম সমন্বয় করা হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়।

তারা আরও বলেন, এপ্রিলের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলারের বিল জমা দিয়েছিল আদানি। তবে দরকষাকষির পর তা ৫৩ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়। এভাবে প্রতি মাসেই বিল কমানো হয়েছে। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনার দাম অনেক কম পড়েছে। তবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আগে কেনা ছিল। তাই তাদের জ্বালানি বিল বেশি পড়েছে। আগামীতে পায়রার বিলও কমে আসবে।

প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুতের উচ্চ দাম নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে শেয়ার বিজ। এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আদানিসহ দেশের পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণ তুলে ধরা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয় ‘চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি: কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!’ আরও বেশকিছু প্রতিবেদন ছাপানো হয় আদানির বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে। সর্বশেষ ১২ জুলাই ছাপা হয়েছে ‘পিডিবিকে আদানির চিঠি: পায়রা-রামপালের চেয়ে জ্বালানি বিল কম রাখবে আদানি!’