মোশারফ হোসেন: আমাদের পরিবারগুলোয় সব সদস্যই সমান্তরাল ভূমিকা পালন করেন। কারও ভূমিকা বেশি, কারও ভূমিকা কিছুটা কম হতে পারে। একেকজনের ভূমিকা একেক রকম হতে পারে। তবে একটি আদর্শ ও সুখী পরিবারে প্রত্যেক সদস্যের ভূমিকাই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে বাদ দিয়ে বা কারও অবদান অস্বীকার করে একটি পরিবার পরিপূর্ণ হতে পারে না। তাই বাবা-মায়ের ভূমিকার সঙ্গে স্বামীর-স্ত্রীর ভূমিকার তুলনা করা উচিত নয়। একইভাবে পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকার সঙ্গে পরিবারের বাইরের কোনো বন্ধুর ভূমিকা গুলিয়ে ফেলা বা বন্ধুর ভূমিকা বড় করে দেখা উচিত নয়। সব সদস্য মিলেই একটি পরিবার গঠন করেন, যেখানে প্রতিটি সদস্যেরই ছোট ছোট তবে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রয়েছে। তাই কে বেশি দায়িত্ব পালন করছেন, কে কম করছেন, কিংবা কে কিছুই করেননি বা বাইরের কে এসে মহাভারত জয় করে দিয়ে গেছেনÑএসব আনুপাতিক হিসাবনিকাশ ও তুলনা পরিবারে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির সৃষ্টি করে।
পরিবার বলতে কী বোঝায়? অথবা পরিবারের সদস্য কারা? ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি বা বাংলাদেশি রীতিতে স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে পরিবার গঠিত হয়। তবে এটি পরিবারের অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ। মাঝারি আকারের একটি পরিবারে বাবা-মাও সদস্য। বড় বা একান্নবর্তী পরিবারে ভাই-বোন, দাদা-দাদিও সদস্য হতে পারেন। একটি পরিবার হচ্ছে একটি বন্ধন, আমৃত্যু অটুট থাকার নাম, সুখে-দুঃখে পাশে থাকার নাম, সর্বদা ভরসা (সাপোর্ট) দেয়ার নাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কালের বিবর্তনে আমাদের পরিবারগুলোয় বন্ধন, সদস্যদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য যেন ম্রিয়মাণ একটি প্রদীপ! আর তাই একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে বহু আগেই। বেদনাদায়ক সত্য হচ্ছে, এখন বাবা-মাকেও পরিবারের সদস্য মনে করেন না কেউ কেউ! কিন্তু আমার কাছে বাবা-মাবিহীন পরিবারের ধারণা অসম্পূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। একটি পরিবারে অবশ্যই বাবা-মাকে অপরিহার্য সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পারিবারিক সম্পর্কের বৃত্তে আবদ্ধ আমরা সবাই যদি এই সত্যটি উপলব্ধি করতাম বা বিশ্বাস করতাম, তাহলে আমাদের সবার জীবন ও প্রতিটি সম্পর্ক মধুর চেয়েও মিষ্টি হতো।
ঐতিহ্যগতভাবে দীর্ঘদিন টিকে থাকা পরিবারগুলো তাদের সদস্যদের মধ্যে মতৈক্যের অভাবে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাব-ফ্যামিলিতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরিবারেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার অভাব দেখা যায়। বউ তার শাশুড়িকে সহ্য করতে পারেন না, একইভাবে শাশুড়িও তার ছেলের বউকে সহ্য করতে পারেন না। বউ তার শাশুড়ির কাছ থেকে মাতৃমমতা আশা করেন, কিন্তু নিজে শাশুড়ির মেয়ে হয়ে উঠতে পারেন না, বা চেষ্টাও করেন না। তার কাছে বিয়ের পরও তার বাবার বাড়িই তার বাড়ি, তার বাবা-ভাইয়েরাই তার আত্মীয়স্বজন! শ্বশুরবাড়িকে নিজের বাড়ি ভাবাটা যেন তার চিন্তায়ও আসে না। একবারও ভাবেন না, মৃত্যুর পর বাবার বাড়িতে নয়, শ্বশুরবাড়ির কবরস্থানই হবে তার শেষ আশ্রয়স্থল। শ্বশুরবাড়ি বলতে তিনি কেবল নিজের স্বামী-সন্তানকেই বোঝেন। ঠিক একইভাবে শাশুড়িও পুত্রবধূর কাছে মেয়ের আনুগত্য আশা করেন, কিন্তু নিজে পুত্রবধূর প্রতি মায়ের মমতা দেখান না। ফলে ‘বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ’, ‘বউ বড় না মা বড়’ নামের একাধিক বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ায় সাফল্যের সঙ্গে এগুলো বিপণন করা হচ্ছে!
বর্তমানে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই শিক্ষিত সদস্যসংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু একইসঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পারিবারিক কলহ কমছে না, বরং অনেক শিক্ষিত পরিবারে এই কলহ বহুগুণে বাড়ছে। সংসার ভেঙে যাচ্ছে। এর তাজা প্রমাণ হচ্ছে, গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন, যেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় দৈনিক ৩৯টি এবং প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাকের ঘটনা ঘটেছে! দাম্পত্য জীবনের এসব বিচ্ছেদে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাব, ত্যাগী মানসিকতার অনুপস্থিতি এবং জেদ তথা ইগুইস্টিক মনোভাব মূল কারণ হলেও এতে অন্য সদস্যদের ভূমিকাও কম নয়। তাছাড়া পরিবারের সদস্য, নিকট স্বজন, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের ইন্ধন ও কূটচালেরও একটা বড় ভূমিকা থাকে যারা ভাবীর বদনাম ভাইয়ের কাছে, শাশুড়ির বদনাম বউয়ের কাছে এবং বউয়ের বদনাম শাশুড়ির কাছে করেন।
বিয়েশাদির মাধ্যমে একটি পরিবারে আরেকটি ভবিষ্যৎ পরিবারের যাত্রা শুরু হয়। এর মাধ্যমে পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন হয়। কিন্তু পরিবারে নতুন কারও আগমন বা নতুন কাউকে গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে, পুরনো সদস্যদের কাউকে ত্যাগ বা বর্জন করতে হবে। নতুন বউ পরিবারে যুক্ত হওয়া মানে এই নয় যে, ছেলের বাবা-মায়ের আর কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না। আবার শ্বশুর-শাশুড়িকেও এমনটা মনে করলে চলবে নাÑ‘আমরা থাকতে ছেলের বউয়ের মাতব্বরি কেন?’ একটি সাধারণ সত্য হলো, পরিবারটির কেউ যদি একই পরিবারে একজনকে গ্রহণ করার জন্য অন্য সদস্যকে ছেড়ে দেন বা ত্যাগ করেন, তবে পরিত্যাগ করা ব্যক্তিটি সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। আর পরিত্যক্ত মানুষটি যদি বাবা বা মা-ই হন, তাহলে সেটি আর পরিবার থাকে না, পরিবার নামক মরুভূমিতে পরিণত হয়। আমি মনে করি, বাবা-মাকে দূরে রাখা পরিবারের সন্তানের জন্ম ব্যর্থ, ইহকাল ব্যর্থ, পরকাল ব্যর্থ।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অভিযোগ প্রবণতা, অবিশ্বাস, অসম্মান ও অসহিষ্ণুতার ফলে একটি পরিবার বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিত, আমরা মানুষ; আর মানবীয় গুণাবলিতে আমরা কেউই পরিপূর্ণ নই। একইভাবে আমাদের বোধগম্যতা, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রহণযোগ্যতা ও সহনশীলতার মাত্রাও সমান নয়। সুতরাং পরিবারের প্রত্যেককেই একে অন্যের স্বার্থের উন্নতির জন্য বা অন্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য তার নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থের সঙ্গে আপস করে ত্যাগের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করা উচিত। সারা দিন পরিশ্রম করে পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরলে অভিযোগ আর কৈফিয়তে তার কান বিদীর্ণ করা অনুচিত। একটি সুখী পরিবার হয়ে শান্তিতে বাঁচতে পরিবারের কর্তাব্যক্তিটিকে পারস্পরিক অভিযোগ ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
পরিবার একটি বাহন হলে কর্তাব্যক্তিটির হাতেই স্টিয়ারিং থাকতে হবে। পরিবারে গণতন্ত্র থাকবে, কিন্তু নেতৃত্ব থাকবে একজনের। পরিবারের সবাই যদি তার নিজ নিজ মতামত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আপন নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চান, নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন চান, তাহলে সেই পরিবারে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে এবং কখনোই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে পরিবারের প্রত্যেকেরই মতামত প্রদানের সুযোগ থাকতে হবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেবল একজনের ওপরই ন্যস্ত থাকা উচিত। সবার মতামত নেয়ার পর যেকোনো বিষয়ে নেতা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটা বিনা বাক্যে সবাইকেই মেনে নিতে হবে সেটা নিজের বিরুদ্ধে গেলেও। তবে কর্তৃত্ব সবচেয়ে বেশি অর্থ জোগানদাতার ওপর ন্যস্ত হলে হবে না। পরিবারের নেতা হবেন তিনিই, যিনি বয়সে মুরুব্বি এবং শিক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধিতে বিচক্ষণ। আদবকায়দা, নম্রতা, মান্যতা আর আনুগত্যের বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব কেবল শিশুদের শিক্ষণীয় বিষয় নয়, পরিবারে ছোট-বড় সবার মাঝেই আদবকায়দা আর নম্রতার চর্চা প্রয়োজন। সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের মান্যতা এবং আনুগত্য শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পরিবারের অন্যতম শর্ত।
ব্যাংক কর্মকর্তা
mosharafmau.200117@gmail.com