পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা ও সমাধানে করণীয়

ওসমান গনি শুভ: বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল এক অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সৌন্দর্যের সেই লীলাভূমিতে বিচরণকারী মানুষগুলো কীভাবে তাদের জীবন অতিবাহিত করছে? বর্তমানে পাহাড়ে যে অশান্তির দাবানল জ্বলছে, এর পেছনে কারণই বা কী? পার্বত্য সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফের হাতে কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক চৌকস সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অশান্তি, সেটা কিন্তু এক দিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে কয়েকযুগের ইতিহাস। পার্বত্য জেলাগুলোর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দূরত্ব মাঝেমধ্যে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয় কেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির প্রথম কারণ শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন। ১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনী ও সরকারের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। দ্বিতীয় কারণ আঞ্চলিক ও পার্বত্য পরিষদের নির্বাচন। শান্তিচুক্তির পর বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি নিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও সেখানে কোনো নির্বাচন হয়নি, এমনকি ভোটার তালিকাও হয়নি। তৃতীয় কারণ ভূমিসমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের জন্য যখন বসতি গড়ে দেওয়া হলো তখন শুরু হলো ভূমি নিয়ে বিরোধ। এ
সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০১ সালে গঠিত হয়েছিল ভূমি কমিশন। কিন্তু গত ১৮ বছরে তারা একটি বিরোধেরও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। চতুর্থ কারণ হলো পাহাড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতি।
চুক্তিতে ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট থাকবে এবং এর বাইরে অস্থায়ী যত ক্যাম্প আছে সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু পাহাড়িদের অভিযোগ চুক্তি অনুযায়ী সেসব করা হয়নি। পঞ্চম কারণ হলো পাহাড়িদের বিভেদ ও আন্তঃকোন্দল। শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে গত ২১ বছরে পাহাড়িদের সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা পিসিজেএসএস (সন্ত লারমা) ও পিসিজেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এমন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ষষ্ঠ কারণ হলো বাঙালিদের বসতি ও অবিশ্বাস। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র লোকজনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। বাঙালিদের সংগঠন দাবি করে পাহাড়িদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ করা হোক। আর পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন ও অন্যান্য সংগঠনের দাবি এসব বহিরাগত বাঙালিদের তাদের আগের জায়গায় ফেরত পাঠানো হোক। সপ্তম কারণ হলো পিছিয়ে পড়া উন্নয়ন ও দুর্গম এলাকা। দুর্গম এলাকার স্থানীয়দের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। দুর্গম এলাকা হওয়ায় উন্নয়নের জন্য সেখানে যে বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ছিল, সেরকম হয়নি।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সন্ত লারমার সঙ্গে সরকারের সম্পাদিত শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত অনুযায়ী সরকার তিন পার্বত্য জেলা থেকে ২৪০টি সেনা ক্যাম্প ও একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নেয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শান্তিচুক্তির অধিকাংশ শর্ত বাস্তবায়ন করেছে সরকার। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রতি সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও শান্তির আলোর দেখা মেলেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাহাড়ি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অস্ত্রের রাজনীতি পার্বত্য তিন জেলার শান্তি কেড়ে নিয়েছে। পরিকল্পিত খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ ও চাঁদাবাজি পার্বত্য অঞ্চলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের চারটি আঞ্চলিক সংগঠন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য দায়ী। এদের কাছে রয়েছে ভয়াবহ মারণাস্ত্র, যা নিমিষেই একটি এলাকা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। অস্ত্রগুলোর মধ্য রয়েছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এস কে ৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪, এম১, এনএন-৪ এবং একে-৩৭।
তবে এদের নির্দিষ্ট বা স্থায়ী কোনো ধরনের সামরিক ক্যাম্প বা সশস্ত্র ঘাঁটি নেই। সবাই ভ্রাম্যমাণ সন্ত্রাসী সংগঠন। কোথাও কোথাও বাঙালিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলো। সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন এলাকার ও দেশের সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি সংগঠনগুলো ঘাঁটি গেড়েছে। রাতের আঁধারে তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানি রোহিঙ্গাদের প্রাণ দুর্বিষহ করে তুলেছে। পার্বত্য দুর্গম এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প অপসারণের পর পাহাড়ি-বাঙালি সবার ওপর নির্দয়ভাবে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি, ধর্ষণ করছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সদস্যরা। এসব অপকর্ম রোধ করতে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর
প্রতি অভিযান চালানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
পাহাড়ি জনগণের স্বার্থে আবার পাবর্ত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প এবং বিজিবি’র ক্যাম্প নির্মাণ
করা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। সমগ্র দেশের একমাত্র পাহাড়বিধৌত অঞ্চলটির আয়তন দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। তিনটি জেলা যথাক্রমে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি। এর মধ্যে রাঙামাটি আয়তনের দিক দিয়ে শুধু পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা। ধারণা করা
হয়, অফুরন্ত বনজ সম্পদসমৃদ্ধ এই অঞ্চল শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, বরং খনিজ সম্পদের
এক অফুরন্ত উৎস।
সাম্প্রতিক একটি জরিপ অনুযায়ী দেখা যায়, এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৭ থেকে ৪৯ শতাংশ বাঙালি, বাকি ৫১ থেকে ৫৩ শতাংশ নৃগোষ্ঠীর জনতা। নৃগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা গোষ্ঠীই সংখ্যায় বড়। মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ হচ্ছে চাকমা জনগোষ্ঠী। এছাড়া অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে মারমা, ত্রিপুরা, তংচংগ্যা, চাক, মুরং, পাংখো, বোম, খিয়াং, খুমি, খাসিয়া, গারো, কুকি, লুসাই, পাঙন ও লাওয়া উল্লেখযোগ্য। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আগে এসেছে কুকিরা। মিয়ানমারের আরাকানি চাকমাদের আগ্রাসনে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছিল কুকিরা। বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আজাদের মতে, চাকমা রাজা মোআন তসনি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে ১৪১৮ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং রামুতে এসে উপজাতি কুকিদের বিতাড়ন করে বসতি স্থাপন শুরু করে।
কালক্রমে মারমা, খিয়াং, লুসাই ও খুমিরা এসে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ১৮৬০ সালে মূলত অশান্তির বীজ রোপিত হয় ইংরেজদের দ্বারা। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি আরোপ করে তারা পুরো ভারতবর্ষে হিংসার বীজ বুনে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যানুয়েল অ্যাক্ট করা হয় ১৯০০ সালে। উপনিবেশগুলোকে সুবিধাজনকভাবে শাসন করা এই বিধিমালা প্রণয়নের আরেকটি কারণ। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘অনিয়ন্ত্রিত এলাকা’ বা ‘নন রেগুলেটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে বহিরাগতদের আগমন ও স্থায়ী বসবাস বন্ধ করে পারস্পরিক ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে পার্বত্য এলাকাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে রাজা, হেডম্যান ও কারবারিদের সাহায্যে এক সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা চালু করা হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পাহাড়িরা এখনও সেই হিংসার অনলে পুড়ে হিংসার নীতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। অথচ এই বিধিমালা পাকিস্তান আমলেও বাতিল করা হয়েছিল একবার।
পাহাড়ি নেতাদের দাবির কথা শুনে মনে হয়, ইংরেজদের এই বিধিমালা বাতিল করার ক্ষমতা স্বাধীন সরকারেরও নেই। একটি জাতিকুলের নেতাদের ভুল বা লোভ কীভাবে সেই জাতির দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ চাকমা ও মারমারা। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় অশান্তির বীজ রোপণ করে দিয়ে যায় তৎকালীন পুরো ভারত উপমহাদেশে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাখে তদানীন্তন পাকিস্তানের অধীনে। এই বিভাজনের দায়িত্বটা দেওয়া হয় রেডক্লিফ কমিশনের প্রধান রেডক্লিফকে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের
সঙ্গে যুক্ত করার একটি অকাট্য যুক্তিও ছিল। সেটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণভাবে পূর্ব-পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু উপজাতিরা চেয়েছিল ভারতের পক্ষে থাকতে। তৎকালীন উপজাতি নেতারা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর চাকমারা রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা এবং মারমারা বান্দরবানে মিয়ানমারের পতাকা উড়িয়েছিল, যে ভুলের মাশুল তাদের পরে
কড়ায়-গণ্ডায় গুনতে হয়েছিল, কারণ পাকিস্তানি
বেলুচ বাহিনী অনতিবিলম্বে সেই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ প্রভৃতি সন্ত্রাসী সংগঠন করে বাংলাদেশের বুক চিরে রক্তক্ষরণ নিশ্চিত করা হয়, যাতে বাংলাদেশে অশান্তির আগুন প্রজ্বলিত রেখে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা সম্ভব হয়। এ ধরনের চেষ্টায় লিপ্ত কিছু অকল্যাণকামী জনগোষ্ঠী। পাহাড়ের বুকে অশান্তির আগুন নেভাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে পাহাড়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে পাহাড়ের বুক থেকে চিরতরে নির্মূল করতে হবে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়