শেয়ার বিজ ডেস্ক : পুরোনো বছর বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করতে পাহাড়ে এখন চলছে সাজ সাজ রব। উৎসবমুখর পরিবেশে চলছে নানা আয়োজন। বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু ও চাংক্রান উৎসব ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িরা মিলিত হচ্ছে মিলনমেলায়। প্রাণের এ উৎসবে রং লেগেছে সব বয়সের মানুষের মনে। গতকাল বুধবার থেকে শুরু হয়েছে পাহাড়িদের প্রধান এ সামাজিক উৎসব।
রাঙামাটি : পাহাড়ের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান বৈসাবি কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। হ্রদের জলে বাহারি ফুল জানান দিচ্ছে শুরু হলো পাহাড়ের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবি। এ সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর-পাহাড়ি গ্রামগুলো। গতকাল বুধবার সকালে কাপ্তাই হ্রদের জলে ফুল ভাসিয়ে নতুন বছরের জন্য শুভকামনা জানিয়ে গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়।
উৎসবটি চাকমা জনগোষ্ঠীর ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘হাঁড়িবসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ে সূচিকাজ। ঠিক ফুলবিজু নামে অভিহিত না হলেও এ দিন প্রায় সব পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী পানিতে ফুল ভাসানোর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে ফুলবিজু উপলক্ষে শহরের রাজবন বিহার ঘাট, পলওয়েল পার্ক, কেরানী পাহাড়সহ বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানিতে ফুল ভাসানো হয়।
শহরের রাজবন বিহার ঘাটে হ্রদের পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেবাশিষ চাকমা বলেন, ফুল বিজু হলো আমাদের বিজু উৎসবের সূচনার দিন। এ দিন আমরা গঙ্গা দেবীকে ফুল নিবেদন করি। যাতে করে আমাদের সমগ্র দুঃখ কষ্ট মুছে যায় এবং নতুন বছরকে যাতে আমরা আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারি।
ফুল ভাসিয়ে সুদর্শন চাকমা বলেন, আমরা এ দিনে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হই। হ্রদের পানিতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল নিবেদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের নতুন বছরের জন্য শুভকামনা আর প্রার্থনা জানাই। পাশাপাশি পানি যেহেতু আমাদের মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই জলের দেবীকে গঙ্গার উদ্দেশে আমরা ফুল নিবেদন করি।
শহরের কেরানী পাহাড় এলাকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ফুল ভাসানো অনুষ্ঠানে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান নিজের আনন্দের কথা জানিয়ে বলেন, আজ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব বৈসাবির তিন দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পাহাড়ের বসবাসরত সমগ্র ক্ষু-নৃগোষ্ঠীদের আমি আমার রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈসাবির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি, এ উৎসব আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে।
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, সাংক্রান, বিহু-২০২৩ উদযাপন কমিটি সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের সবচেয়ে বড় এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা কিছুদিন আগ থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করেছি। ফুল ভাসানেরা মধ্য দিয়ে আগামী তিন দিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সবাই যাতে নতুন বছর ভালোভাবে কাটাতে পারে সেই কামনা করি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় জানানোর এ অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এ উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে। বৈসুকের ‘বৈ’ সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে পাহাড়ের সব জনগোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে উৎসবে একীভূত করার জন্য এই সংক্ষেপে নামটি প্রচলন করা হয়।
বান্দরবান : বৈসাবী উৎসবে রং লেগেছে পাহাড়ে। শঙ্কামুক্ত মঙ্গলময় পৃথিবী কামনায় বান্দরবানে সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসালেন চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা। শিশু-কিশোর এবং য্বুক যুবতীরাও ভিড় জমিয়েছিল নদীচরে বিজু ও বিষু আনন্দ আয়োজনে।
আয়োজকরা জানায়, নতুন বছরকে বরণ এবং পুরোনো বছরকে বিদায় জানানোর সামাজিক এ উৎসবকে চাকমা সম্প্রদায় বিষু ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় বিজু নামে পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এবার তিন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে পাহাড়ি পল্লিগুলোতে। উৎসবের প্রথম দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফুল সংগ্রহ করেন। সংগ্রহের পর ফুলের একটি অংশ মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের প্রার্থনায় ব্যবহার করেন। আরেকটি অংশ গঙ্গায় অবস্থানরত মায়ের চরণে বিশ্ববাসীর শান্তি ও মঙ্গলময় সুন্দর জীবন গড়তে নদীতে ফুল ভাসানো হয় বা প্রদর্শন করা হয়।
চাকমা তরুণী সুচরিতা চাকমা ও শুভশ্রী চাকমা বলেন, উৎসবের প্রথম দিনে নদীতে ফুল ভাসিয়ে পুরোনো বছরের যতসব অমঙ্গল এবং দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি রয়েছে, সব ধুয়ে মুছে ফেলে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করা হয়।
বিষু উৎসব আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্রিত্তিমান চাকমা বলেন, বর্ষবরণ ও বর্ষ বিদায়ের এ উৎসবে তিন দিনব্যাপী নানান অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। নদীতে ফুল ভাসানো ছাড়াও চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা নাটিং এবং বাঁশহরম প্রতিযোগিতা রয়েছে। সাংস্কৃতিক আয়োজনে মাতানো হয় চাকমা পল্লিগুলো।