পাহাড়ে হত্যা থামবে কবে?

 

মারুফ হাসান ভূঞা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কোনো আলাদা সংগ্রাম ছিল না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এ দেশের নাগরিক হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ করেছে। সার্বভোমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার এ যুদ্ধে দেশের অন্যান্য প্রান্তের সমগ্র বাঙালির মতো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ধর্ম, বর্ণ, জাত বিচার করেনি। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দেশকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত করা। তাই বাংলাদেশের বিজয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবদানকে আলাদা করে বিচার করার কোনো সুযোগ নেয়। পাহাড়ি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ও স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এসেছে।

কিন্তু বিজয়ের ৫৩ বছর পরে এসেও বাংলাদেশের আদিবাসীদের টিকে থাকার নিষ্ঠুর সংগ্রাম চালিযে যেতে হচ্ছে। তাদের দুঃখ, দুর্দশা, সংকট দেখার যেন কেউ নেই। তাদের পরিপূর্ণভাবে এদেশের নাগরিক বলে ভাবতে পারেন না এখনও এদেশের বাঙালিরা। প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়। সাধারণ বাঙালিদের কথায় ও আচরণে এমন একটি ভাব প্রচ্ছন্নভাবে ফুটে ওঠে যে আদিবাসীরা বাঙালিদের দয়ায় এদেশে পরজীবীর মতো বাস করছে। নিজের দেশে তাদের আশ্রিত বা উদ্বাস্তুর মতো আচরণ সহ্য করতে হয়। তাদের সামাজিকভাবে অবমূল্যায়ন করা হয় এদেশে। এছাড়া উপহাস করা হয় তাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, পোশাক ও মুখের আদল নিয়ে। তাদের ডাকা হয় ‘উপজাতি’। খোলা চেখে এসব প্রাত্যহিক নির্যাতন অনেকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু যাদের এভাবে ভুগতে হয়, তারা জানে এ অস্তিত্বের সংকট কতটা যন্ত্রণার।

অথচ অনেকেই হয়তো অনুধাবন করতে পারে না যে যেসব নাগরিক ও সামজিক সুবিধা আমরা খুব সহজেই উপভোগ করতে পারি, তার অনেক কিছুই আদিবাসীদের জন্য বিলাসিতা। পাহাড়ের মানুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণ সমতলের মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। পাহাড়ের মানুষ চাইলেই স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে না। পাহাড়ে খাদ্য উৎপাদনও অপেক্ষাকৃত অনেক কঠিন। এছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগও তাদের অনেক কম। ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণে পাহাড়ে সমতলের মতো অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি করা যায় না। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সামন্য কিছু সুবিধা দিয়ে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের কিছু চেষ্টা করা হয়েছে বটে। কিন্তু তাদের কঠিন বাস্তবতার তুলনা তা খুব বেশি কিছু নয়।

পাহাড়ের মানুষদের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব বদলাতে নিয়মকানুন বা কোটা সুবিধা দিয়ে আসলে তাদের প্রতি প্রকৃত বৈষম্যের অবসান ঘটবে না। তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে বসবাস করার স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। তাদের ওপর সংঘটিত অন্যায়-অত্যাচারের কথা বলার অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রের মদদে অঘোষিত সেনা শাসন জারি রাখা হয়েছে পাহাড়ে। প্রাত্যহিক জীবনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর চাপানো হয় নিত্যনতুন নিষেধাজ্ঞা। তাদের নাগরিক অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনিশ্চিত জীবনের প্রতীক্ষায় তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

অন্যদিকে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও সংঘাত ছড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। যাতে সম্পূর্ণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করা যায়। এ সুযোগে চলছে পাহাড়ের মানুষদের ওপর শোষণ ও নিপীড়ন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর তাদের ওপর এ নির্যাতন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ১৯৮০ সালে সশস্ত্র বাহিনী ও শৃঙ্খলহীন বাঙালি মুসলিম সদস্যরা যৌথভাবে কাকজলি গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ৩০০ জন আদিবাসীকে হত্যা করে। ১৯৮১ সালের ৩ মার্চ ও ২৫ মার্চ দুই ধাপে আক্রমণ করে মাটিরাঙায় পাহাড়ের মানুষদের হত্যা করা হয়। ১৯৯২ সালে লোগাংয়ে মর্মান্তিকভাবে অনেক মানুষকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময়ও গুলি করে ও জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে। কেন এই হত্যা-গুম? কী অপরাধ পাহাড়ি অধিবাসীদের?

সমতলের মানুষদেরও অনেক রকম রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। কিন্তু নিজের দেশে পরাধীন জনগোষ্ঠীর মতো জীবন কাটানো সে বঞ্চনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। আজ দীর্ঘকাল ধরে তাদের বাকরুদ্ধ করার জন্য ও নিজস্বতাকে খর্ব করার জন্য অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হচ্ছে।

দীর্ঘ বঞ্চনার ফলাফল হিসেবে পাহাড়েও গড়ে উঠেছে বেশ কিছু উগ্র রাজনৈতিক ও সামরিক দল। পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন তাদের মৌলিক দাবি। এ দাবি আদায় নিয়ে এসব দলের কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই-সংগ্রাম করছে। নানা সময়ে এই লড়াই, সংগ্রাম বড় সংঘাতে পরিণত হয়। ফলে নির্বিচারে সাধারণ আদিবাসীদের হত্যা, গুম করা হয়। উল্লেখ্য, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের ২৭ বছর পার হয়েছে। কল্পনা চাকমা এখনও নিখোঁজ। গত ১১ ডিসেম্বর রাতে পানছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পিসিপির সহ-সভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতা লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে হত্যা করা হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি বা করেনি প্রশাসন। শুধু এ ঘটনাই নয়। পাহাড়ে আজ পর্যন্ত সংঘটিত হওয়া কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি।

সবুজ পাহাড় রক্তাক্ত হয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রক্তে। পাহাড়ের মানুষদের কেন বারবার রক্ত ঝরাতে হবে?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কারণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাদের নিয়ে কথা বলাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে না। কারণ তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে উপজাতি হিসেবে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এদেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে একজন সমতলের মানুষের যেমন অধিকার, স্বাধীনতা রয়েছে, একইভাবে আদিবাসীদেরও সেই অধিকার, সেই স্বাধীনতা রয়েছে। সুতরাং সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে পাহাড়ে অঘোষিত সেনাশাসন প্রত্যাহার করে পাহাড়ি মানুষদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগ দিন।

শিক্ষার্থী

ফালাহিয়া মাদ্রাসা, ফেনী