বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। তিনি পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কার, ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি, নীতিগত সহযোগিতা এবং ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় আইপিও জারি নিয়ে যেসব সুপারিশ ও উদ্যোগের কথা বলেছেন, সেগুলো দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত। বিশেষ করে এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুঁজিবাজারকে মূলধন আহরণের কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
তবে এই ইতিবাচক আশাবাদের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা ওঠে এসেছে, তা হলোÑ সিকিউরিটিজ হাউস ও বিএসইসির মধ্যে সেন্ট্রাল কাউন্টার অ্যাকাউন্ট (সিসিএ) ঘিরে চলমান টানাপোড়েন। সিসিএর সুদ আয়ের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিএসইসির নতুন নির্দেশনায় হাউসগুলো যে উদ্বেগ জানিয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক বিরোধ নয়, বরং এটি একটি আর্থিক বাস্তবতার প্রতিফলন। করোনাত্তোর সংকট, ঋণাত্মক মূলধনের চাপ এবং বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটের মধ্যে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো যে সিসিএর সুদ আয় নিজেদের ব্যয় নির্বাহে ব্যবহার করে আসছিল, তা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া তাদের টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অন্যদিকে বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই এই অর্থ ব্যবহৃত হবে প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা তহবিলে। এতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক শিক্ষা ও ঝুঁকিরোধ ব্যবস্থার উন্নতি হবেÑ এমন অভিপ্রায়কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ এই পরিবর্তন যদি হাউসগুলোকে ব্যবসায়িকভাবে অচল করে দেয়, তাহলে এই শিক্ষিত ও সুরক্ষিত বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন কোথায়?
বাস্তবতা হলোÑ পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে হলে কেবল নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তব ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকেও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। হাউসগুলোর আর্থিক টিকে থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষাও অনিবার্য। এখানে সমন্বয়ের প্রয়োজন। সিসিএর আয় ব্যবস্থাপনায় একটি মধ্যপন্থা অনুসন্ধান জরুরি, যা একদিকে হাউসগুলোকে ধ্বংস করবে না, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের উপকারেও আসবে। পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে প্রশিক্ষণ, স্বচ্ছতা, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং আইনগত আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে নীতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ, বাস্তবতা বিবেচনা ও ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন কৌশল গ্রহণ করাই হবে অধিকতর ফলপ্রসূ।
দেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরেই আস্থাহীনতা, স্বল্প তারল্য ও কাঠামোগত দুর্বলতায় ভুগছে। একাধিক সংকট, নীতির অস্থিরতা ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এর মূল কারণ। এ অবস্থায় বড় কোনো সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটি যেন বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ভারসাম্যহীন চাপ সৃষ্টি না করে- এ বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য শুধু নীতির দৃঢ়তা নয়, দরকার ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত।
সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাজারের অংশীজনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও টেকসই পুঁজিবাজার গড়ে তোলা সম্ভবÑ এখন সময় সেই বাস্তবতাকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে যাওয়ার।