বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে কারসাজি যেন নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি চক্র কারসাজি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট কাটে, নিজেদের টাকার পাহাড় গড়ে, তারপর নির্বিঘ্নে আড়ালে চলে যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ফরচুন সুজের সামপ্রতিক শেয়ার কারসাজি কাহিনি তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২০২১ সালে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ফরচুন সুজের শেয়ারদর প্রায় ৪৮৩ শতাংশ বেড়ে যায়। ১৮ টাকা থেকে ১০৫ টাকায় পৌঁছায় কোম্পানিটির শেয়ারদর, পরে তা সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির নেপথ্যে ছিলেন আবুল খায়ের হিরু নামের এক ব্যক্তি এবং তার সিন্ডিকেট। তদন্তে ওঠে এসেছে, ফরচুন সুজের মালিকপক্ষ এবং হিরুর ঘনিষ্ঠরা মিলে পুঁজিবাজারে ‘সাজানো তথ্য’ ছড়িয়ে একটি কৃত্রিম উন্মাদনা তৈরি করেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মুনাফার আশায় আকৃষ্ট হন, আর এই সুযোগে চক্রটি কোটি কোটি টাকা তুলে নেয়। ফলাফল- যারা শেষে শেয়ার কিনেছিলেন, তারা আজ সর্বস্বান্ত; শেয়ার এখন মাত্র ১৫ টাকার ঘরে।
প্রশ্ন ওঠে, এত বড় কারসাজির সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) কী করছিল? তদন্তের পরও কেন দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? জানা যায়, আগের কমিশনের আমলে তদন্ত হলেও, রহস্যজনক কারণে শুধু নামমাত্র জরিমানা করে দায়সারা হয়েছে। বরং হিরু ও তার সহযোগীরা বিদেশে বাড়ি করেছেন, ব্যবসা বিস্তার করেছেন, অথচ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ফরচুন সুজ কেলেঙ্কারিতে ক্রীড়াজগতের তারকাদেরও জড়িয়ে পড়ার খবর এসেছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটারের নামও এই কেলেঙ্কারির আলোচনায় এসেছে, যদিও এখনও তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত কোনো অভিযোগ নেই। তবুও তারকাদের এই ধরনের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ-মনোবলকেও ধাক্কা দেয়। মানুষ যখন দেখে তার আদর্শ ভাবা ব্যক্তিরাও সন্দেহজনক ব্যবসায় জড়িত, তখন পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা তলানিতে ঠেকে যায়। সরকার ও বিএসইসি এবার নতুন করে ফরচুন সুজের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে। আমরা চাই, তদন্ত যেন লোকদেখানো না হয়। পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। এখানে সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন। বিনিময়ে তারা নিরাপত্তা ও ন্যায্য লভ্যাংশের প্রত্যাশা করেন। যদি পুঁজিবাজার কারসাজির আখড়া হয়ে দাঁড়ায়, যদি প্রভাবশালীরা বারবার আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে।
ফরচুন সুজ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি কঠিন শিক্ষা হওয়া উচিত। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করতে হবে। পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে চাই কঠোর মনিটরিং, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। আর চাই, যারা সাধারণ মানুষের কাঁধে পা রেখে টাকার পাহাড় গড়েছে, তারা যেন অবশেষে আইনের কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই না পায়।