পুঁজিবাজারের উন্নয়নে তালিকার বাইরে থাকা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান আগের মতো সর্বনিম্ন ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এজন্য পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির করের বোঝা তালিকাভুক্ত কোম্পানির চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে কোম্পানির ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সচিব নাজমা মোবারককে গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
দেশি বা বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করতে এ করসুবিধা প্রদান আবশ্যক, যা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে গুণগত মানসম্পন্ন কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এবং বাজারকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল ও স্থিতিশীল করতে এ করসুবিধা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করে বিএসইসি।
খন্দকার রাশেদ মাকসুদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরেই মৌলভিত্তিসম্পন্ন, লাভজনক ও স্বচ্ছ কোম্পানির অভাবে ভুগছে। এর ফলে বাজারের গভীরতা অত্যন্ত সীমিত, যা দীর্ঘ মেয়াদে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনের পথে বড় বাধা। এই পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। বাংলাদেশে বহু লাভজনক দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, যাদের ব্যবসা শক্তিশালী এবং আয়ও উল্লেখযোগ্য। তবে এসব কোম্পানির অধিকাংশই এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ তালিকাভুক্ত ও তালিকার বাইরে থাকাকোম্পানির মধ্যে করহারে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যের অভাব। ২০২৪ সালের অর্থ আইন অনুযায়ী, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারে এই ব্যবধান মাত্র ৫ শতাংশ, যা ভালো ও মৌলিকভাবে শক্তিশালী কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আরও নিরুৎসাহিত করছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়, তারা সাধারণত নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করে, সুশাসন মেনে চলে এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে। করহারে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে এই দায়িত্ববান আচরণকে পুরস্কৃত করা সম্ভব হবে এবং অন্যান্য ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করবে। ভালো কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে, কারণ তারা টেকসই আয় ও সুশাসনের আশ্বাস পায়। এটি বাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল করে এবং বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায়। এ ছাড়া ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। আপাতদৃষ্টিতে কর ছাড় মানেই রাজস্ব ঘাটতি মনে হলেও তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়লে ব্যবসার পরিধি ও করনির্ভরতা উভয়ই বাড়ে। কর আদায়ে স্বচ্ছতা বাড়ে এবং দীর্ঘ মেয়াদে মোট রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। অনেক উন্নয়নশীল ও মধ্য-আয়ের দেশ, যেমন মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত প্রভৃতি দেশ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কর সুবিধা দিয়ে সফলভাবে ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারমুখী করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে অধিকাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হলে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ কমে আসবে এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস পাবে। অন্যদিকে বেশিসংখ্যক ও বৈচিত্র্যময় কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বাজারের গুটিকয়েক কোম্পানির মূল্য ওঠানামার ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। এতে সূচকের ওঠানামায় অস্থিরতা হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগকারীদের ইতিবাচক বার্তা দেয়।
চিঠিতে বিএসইসি চেয়ারম্যান জানান, দেশি/বিদেশি/বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যাতে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে উৎসাহিত হয়, সেজন্য করসুবিধা প্রধান আবশ্যক যা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানা ধরনের খরচ বহন করতে হয় বলে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে উপরিল্লিখিত করহারের ব্যবধান আগের মতো সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এই পদক্ষেপ পুঁজিবাজারে গুণগত মানসম্পন্ন কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, বাজারকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল ও স্থিতিশীল করে তুলবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আর্থিক খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।