পুঁজিবাজারে পতন ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে বিনিয়োগ!

আতাউর রহমান: ধীরে ধীরে সূচক কমাসহ লেনদেন তলানিতে নেমে এসেছে দেশের পুঁজিবাজারের। একই সঙ্গে কিছু শেয়ারদর বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া বেশিরভাগ শেয়ারে হচ্ছে পতন বা থাকছে অপরিবর্তিত। এর কারণ হিসেবে ফ্লোর প্রাইসকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারের দাম না কমায় কোনো চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। সেই সঙ্গে অনেকে আটকে থাকা শেয়ার বিক্রি করে নতুন শেয়ার কিনতে পারছেন না। এতে ফ্লোর প্রাইস তুলে চাহিদা ও সাপ্লাই না বাড়ানো পর্যন্ত পুঁজিবাজার ভালো হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।

এছাড়া ফোর্স সেল স্থগিত রাখা, মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে সময় বৃদ্ধি করা, ব্রোকারেজ ও ডিলারদের লোকসানে প্রভিশন রাখার সময় বাড়ানো, সোর্স ট্যাক্স বাতিল বা কমানো এবং গ্রাহক সমন্বয় হিসাবের অতিরিক্ত টাকা ডিএসইকে না দেয়াসহ বেশ কয়েকটি সমস্যা সমাধানের বিষয় জানিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা। এতে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলেও কিছু সময় বাজার সমন্বয় হলেও সংশ্লিষ্ট কারও বড় ক্ষতি হবে না বলে জানান তারা। কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য বাজার ভালো হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

গত দুই মাসের বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুঁজিবাজারে দুই মাসের মধ্যে দুই থেকে তিন সপ্তাহে সূচক ও লেনদেন বেড়েছে। বাকি সপ্তাহগুলোয় সূচক ও লেনদেন কমেছে। এতে সূচক এখনও ছয় হাজার ২০০ পয়েন্টে থাকলেও লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার ঘরে। তাই সূচক ফ্লোর প্রাইসের কারণে কৃত্রিমভাবে রাখা গেলেও লেনদেন ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান বিশ্লেষকরা।

তথ্যমতে, দুই মাসের মধ্যে প্রথম সপ্তাহে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক কমে দাঁড়ায় ছয় হাজার ১৯৪ পয়েন্টে। সে সপ্তাহে লেনদেন ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে। এর পরের সপ্তাহে সূচক ২১ পয়েন্ট বেড়ে ছয় হাজার ২১৫ পয়েন্টে দাঁড়ায় এবং একই সঙ্গে লেনদেন ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ঠিক একইভাবে পরবর্তী সপ্তাহে এসে সূচক ৫০ পয়েন্ট এবং লেনদেন ৮১ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু পরের সপ্তাহে এসে সূচক ৩০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ২০ শতাংশ কমে যায়। এ সময় সূচকের পতন ঘটেÑসূচক ১ দশমিক ৫০ পয়েণ্ট কমে এবং লেনদেন সাত শতাংশ কমে।

ধীরে ধীরে সূচক পতনের হার বাড়তে থাকে, তবে লেনদেন বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সপ্তাহে সূচক ১১ পয়েন্ট কমে এবং লেনদেন ১৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এর পরের সপ্তাহে সূচক ও লেনদেনের বড় পতন ঘটে। আলোচ্য সময়ে সূচক ৩৭ পয়েন্ট এবং লেনদেন ৩৫ শতাংশ কমে যায়। গত সপ্তাহে সূচক ৪১ পয়েন্টের বেশি কমে এবং লেনদেন ৩৫ শতাংশের বেশি কমে তলানিতে নামে। সবশেষ গতকাল সূচক ২৩ পয়েন্ট কমে এবং লেনদেন কিছুটা বাড়লেও ২৩১ কোটি টাকা ছিল।

এদিকে বাজারকে এ অবস্থা থেকে ফেরাতে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়াসহ বড় পতন ঠেকাতে কিছু পরামর্শ দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা। ফ্লোর প্রাইস তুলে চাহিদা (ডিমান্ড) ও সরবরাহ (সাপ্লাই) ঠিক রাখার বিষয়ে তারা বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে পুঁজিবাজারে বর্তমানে ডিমান্ড ও সাপ্লাই চেইন ঠিক নেই। অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকলেও কেউ বিক্রি করতে পারছেন না। এ কারণে শেয়ার বিক্রি করে নতুন শেয়ার কিনতেও পারছে না। এছাড়া বড় বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়ে শেয়ারদর কমার অপেক্ষায় রয়েছে। বাজারের বেশিরভাগ শেয়ার অতিরিক্ত দামে রয়েছে, যেগুলো কমে স্বাভাবিক অবস্থানে এলে বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আসবেন।

তবে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে যে বড় পতন হতে পারে,  সে বিষয়ে তারা বলেন, এতে শেয়ারদর কমতে শুরু করবে। বাজারে পতন ঘটবে, তবে সূচক কমলেও লেনদেন বাড়বে বলে জানান তারা। কিন্ত এটা যেন বড় পতনের দিকে না যায়, সেজন্য ফোর্স সেল স্থগিত রাখতে হবে। সেটা আগামী এক থেকে দু বছরের জন্য আদেশ আকারে জারি করতে হবে, যাতে যেসব মার্জিন ঋণ নেয়া বিনিয়োগকারী রয়েছেন তারা ফোর্স সেল না করেন। এজন্য চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্জিন ঋণ সমন্বয়ের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এর সময় বাড়িয়ে দিতে হবে।

অপরদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যাতে প্রভিশন ঠিক রাখতে বিনিয়োগ তুলে না নেন, সেজন্যও ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্রোকারেজ ও ডিলারদের ইকুইটিতে এবং পোর্টফোলিওতে যে লোকসান রয়েছে এর বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখার বিষয়ে সময় বাড়িয়ে দিতে হবে, যাতে সময় নিয়ে প্রভিশন রাখার সুযোগ পেলে প্রাতিষ্ঠানিকরাও বিনিয়োগ ঠিক রাখেন। আলোচ্য পদক্ষেপগুলো যদি নেয়া হয় তবে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলেও বড় পতন হবে না বলে আশা জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে এনসিসিবি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মনজুরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারের বর্তমান অবস্থা দেখে আমরা সবাই এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। সেক্ষেত্রে বড় পতনের আশঙ্কা রয়েছে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সাত থেকে আটটি সিদ্ধান্ত যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নেয়, তবে সে পতন আটকানো সম্ভব বলে তিনি আশাবাদী।

তিনি আরও বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুললেই মার্জিন নিয়ে থাকা বিনিয়োগকারীরা ফোর্স সেল শুরু করবে। তখনই বড় পতনের দিকে যাবে বাজার। সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকদের জন্য মার্জিন সমন্বয়ের সময় বাড়ানো এবং ফোর্স সেল স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হলে তবে তা কার্যকর হবে না। একই সঙ্গে ব্রোকারেজ-ডিলারদের লোকসানের বিপরীতে যে প্রভিশন রাখার সময় এ বছর পর্যন্ত দেয়া হয়েছে, তা বাড়াতে হবে। এ বিষয়গুলোয় স্বল্প সময় নয়, দুই থেকে পাঁচ বছর নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো সময় নিয়ে প্রভিশন সমন্বয় করবে, তাড়াহুড়ো করে শেয়ার বিক্রি করবে না এবং বাজারেও আতঙ্ক সৃষ্টি হবে না।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সোর্স ট্যাক্সের বিষয়ে তিনি জানান, ব্রোকারেজদের কাছ থেকে যে পাঁচ শতাংশ সোর্স ট্যাক্স নেয়া হয়, তা বাতিল বা কমাতে হবে। দেখা যায় বাজার ভালো বা খারাপ থাকুক, আর বছর শেষে লাভ বা লোকসান হোক সোর্স ট্যাক্স আগেই দিতে হয়। সেক্ষেত্রে বছর শেষে প্রতিষ্ঠানের লোকসান হলেও আগে সোর্স ট্যাক্স দিয়ে পরে আবার কর দিতে হচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক চাপের। তাই এটা বাতিল করলে সবচেয়ে ভালো হয়। সেটা সম্ভব না হলেও কমিয়ে দুই থেকে তিন শতাংশ করা হলেও চলবে। ফ্লোর প্রাইস তুলে এ পদক্ষেপগুলো নেয়া হলে বাজারে বড় পতন হবে না, সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধি মাধ্যমে পুঁজিবাজারও এগিয়ে যাবে বলে আশা রাখি।