পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে বাড়িয়েছে পরিবহনে

শেখ আবু তালেব: ঘটনা, সমালোচনা ও কয়েকটি কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাত। এতে কিছুটা ইমেজ সংকটে পড়েছে খাতটি। এ কারণে গত এক বছরে খাতটি থেকে আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে। কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষায় নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে কয়েকটি। এতে করে আমানত কমলেও বেড়েছে ঋণ।

আবার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে পরিবহন খাতে বাড়িয়েছে চারগুণ। অন্যান্য খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ বাড়িয়েছে কৃষি, ট্রেড ও শিল্প খাতে। নতুন খাত বিবেচনায় ঋণের জন্য সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছে এসএমই খাত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন ও খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমন তথ্য।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এক বছর শেষে গত সেপ্টেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত বেরিয়ে গেছে ৫৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৩১ কোটি টাকাই গিয়েছে বেসরকারি খাতের এনবিএফআই থেকে।

অপরদিকে এই সময়ে ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ যে পরিমাণ আমানত বেরিয়ে গেছে, তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ ঋণ বেড়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের এনবিএফআইয়ের ঋণের স্থিতি ছিল ৬৮ হাজার ৯৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। গত সেপ্টম্বর শেষে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৬০৮ কোটি ২৬ লাখ টাকায়। সার্বিকভাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠনের সভাপতি ও আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনার প্রভাবে আমানত কিছুটা কমেছে। কিন্তু ব্যাংক পর্যায়ের আমানত কিছুটা কমেছে। বন্ড ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে বেশি। এজন্য আমানত কিছুটা কম দেখাচ্ছে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানের বেলায় এটি নয়। এর মধ্যেও অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও আমানত দুটিই বেড়েছে। এর মধ্যে আইপিডিসিও রয়েছে।’

পরিবহন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার আঘাত বিশেষ করে লকডাউনের সময় সরাসরি আঘাত পাওয়া খাতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশের যাত্রী পরিবহন খাত। কিন্তু পণ্য ও নদীপথের কার্গো পরিবহন খাতে উল্টো হয়েছে। এ খাতের ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় মুনাফা বেশি হয়েছে। এজন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে লিজিং ফাইন্যান্সে গত এক বছরে প্রায় চারগুণ বিনিয়োগ বাড়িয়েছে এনবিএফআই। খাতটিতে ভালো রিটার্ন দেখছে অনেকেই।

তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের পরিবহন (বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, নৌপথে চলাচলকারী ছোটো-বড় জাহাজ) খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এক বছর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৭৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এক বছরে এ খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে তিন দশমিক ৭০ গুন। কিন্তু এ খাত থেকে বিনিয়োগ কমেছে দেশের পুঁজিবাজারে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এনবিএফআইগুলোর দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল এক হাজার ৩২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এক বছর পরে গত সেপ্টেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৮৭ কোটি টাকায়।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে আনার বিষয়ে মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর পুঁজিবাজারের সূচক ভালো অবস্থানে ছিল। কিন্তু এর পরই কমতে শুরু করে। সতর্কতার অংশ হিসেবে এনবিএফআইগুলো বিনিয়োগ কমিয়ে এনেছে। আবার বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই।’

জানা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষেও দেশের এনবিএফআইগুলোয় আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৪ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর পর থেকেই কমতে শুরু করে খাতটির আমানত। সেই বিবেচনায় গত ৯ মাসে আমানত কমেছে ৬৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ৯ মাসে নতুন যুক্ত হওয়া ১১১ কোটি টাকাও বেরিয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার তীব্র প্রকোপের সময়ে অনেক ব্যাংকই নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। এসময়ে এনবিএফআইয়ের থাকা আমানতে টান দেয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই তা ফেরত দেয়। বিশেষ করে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারি এ ঘটনাকে উসকে দেয়। পরে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা কামনা করে খাতটির সংগঠন।

এতে করে আমানত কমে গেছে এনবিএফআইয়ের। জানা গেছে, খাতওয়ারি বিনিয়োগে গতানুগতিক থাকলেও কৃষি, পরিবহন ও শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে পরিবহন খাতে কয়েকগুণ বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। এর পরেই বিনিয়োগের শীর্ষে থাকা খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে এক হাজার ২৫ কোটি টাকা, শিল্পে এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ও নির্মাণ খাতে ৩৭৭ কোটি টাকা।