শেখ আবু তালেব: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। কোনো ব্যাংক তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে এর বাইরে অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক, যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আওতায় হিসাব করা হবে না।
৩৬ ব্যাংক এ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। বর্তমানে তহবিলের আকার দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুুকুক বন্ডেই বিনিয়োগ করেছে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
২০২০ সালে তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে সরকার ও বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গড়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বিশেষ তহবিল গঠনের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১ সালের ৩১ আগস্ট একটি নীতিমালার মধ্যে এ বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন ঘোষণার পর এ পর্যন্ত ৩৬ ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠন ও পরিচালনা করছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এ তহবিলে আকার দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৭২০ কেটি টাকার। তহবিল থেকে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হয়েছে তিন হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে শুধু সুকুক বন্ডে। আর শুধু শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে দুই হাজার ৮৯ কোটি টাকা। আর বিনিয়োগযোগ্য অর্থ কাছে রয়েছে দুই হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ যেকোনো সময়ে বিনিয়োগ করতে পারে ব্যাংকগুলো।
পুঁজিবাজারের বড় পতন হলে বাজারের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ছয় দফা নির্দেশনার আলোকে প্রতিটি ব্যাংককে কিছু শর্তে ২০০ কোটি টাকার ‘বিশেষ তহবিল’ গঠন করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলো তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। ব্যাংকের এ বিনিয়োগসীমার মধ্যে ব্যাংকের ধারণ করা সব ধরনের শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট রয়েছে। পুঁজিবাজার নির্দেশনাপত্র অনুযায়ী সব বিনিয়োগের হিসাব বাজারমূল্য ধরা হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত অর্থের বিপরীতে পাওয়া শেয়ার ও ইউনিটের বাজারমূল্য ধরেই হিসাব করা হবে। কিন্তু বিশেষ এই তহবিলের বিনিয়োগকৃত অর্থ পুঁজিবাজার এক্সপোজারের বাইরে থাকবে। অর্থাৎ এটি প্রচলিত অর্থে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ধরা হবে না। ব্যাংকগুলো এই সুবিধা ভোগ করবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা হচ্ছে ৬১টি। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে ৩৩টি। আর পুঁজিবাজারে বিভিন্ন ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে ৩৫টি। ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টি তহবিল গঠন ও পরিচালনা করছে। এ হিসাবে বিশেষ তহবিলের আকার হবে সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু তহবিলের আকার হয়েছে পাঁচ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত আকারের সর্বোচ্চ অবস্থানে যায়নি। এখনও ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলে আরও এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকা এ তহবিলে যোগ করতে পারে।
বিনিয়োগের জন্য পড়ে থাকা ও অনুমোদিত তহবিল যোগ করলে দেখা যায়, বিনিয়োগের আওতায় আসেনি তিন হাজার ৭১০ কোটি টাকা। বাজার পরিবেশ থাকলে এ পরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলেই বিনিয়োগ করতে পারে।
যদিও ব্যাংকগুলোকে সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কিন্তু কোনো ব্যাংকই এরূপ তহবিল গঠন ও পরিচালনা করতে বাধ্য নয়। কোনো ব্যাংক ইচ্ছা করলে এটি করতে পারে। আবার বিনিয়োগের পরিমাণও নির্ধারণ করা হয়নি। অর্থাৎ একটি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত তহবিল গঠন ও পরিচালনা করতে পারবে। কিন্তু কত টাকার তহবিল গঠন করবে, এটি নির্ভর করছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের ওপর। ফলে হাঁকডাক দিয়ে এ তহবিল তহবিল গঠন করা হলেও ব্যাংকগুলো খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
ব্যাংকের বিনিয়োগে অনাগ্রহের বিষয়ে এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘একে তো ভালো মানের শেয়ারের সংখ্যা খুবই কম, তার ওপর বাজার ভোলাটাইল (স্থির নয়)। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। আবার বিনিয়োগ করলেই তো হবে না, পুঁজিই যদি চলে যায়, তাহলে লোকসান তো ব্যাংকের। এর দায় কে নেবে। এজন্য সবাই সতর্ক হয়ে বিনিয়োগ করছেন।’
নীতিমালা অনুযায়ী, বিশেষ এই তহবিলের অর্থ দিয়ে সব ধরনের শেয়ার ও ইউনিট ক্রয় করতে পারবে না, শুধু ‘এ’ ক্যাটেগরির শেয়ার ও ইউনিটে বিনিয়োগ করতে পারবে। এর বাইরে কয়েকটি খাত ও একক খাত হিসেবে সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, প্রতি মাস শেষ হলে পরবর্তী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট ছক অনুসারে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব, বিও হিসাব/হিসাবগুলোর বিবরণীসহ সব তথ্য অফসাইট সুপারভিশন বিভাগে জমা দিতে হবে। এই অর্থ নিজেদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে ঋণ দিতে পারবে। এক্ষেত্রে ঋণদানকারী ব্যাংক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করবে। সমন্বিত আকারে ছকে সংযোজন করে অনলাইনে জমা দিতে হবে ব্যাংকে। এজন্য ব্যাংকগুলোয় একটি নির্দিষ্ট ছক তৈরি করে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারল্যর জোগান দিতে বিশেষ তহবিল গঠনে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল/ট্রেজারি বন্ড রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। আবার ইচ্ছা করলে প্রথমে নিজেদের অর্থে তহবিল গঠন করে পরেও ট্রেজারি বিল/ট্রেজারি বন্ড রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা যাবে।