পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, কারসাজি ও লুটপাটের শিকার হয়ে জনআস্থা হারিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের জন্য একটি সুসংগঠিত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুঁজিবাজার অপরিহার্য হলেও আমাদের বাস্তবতা তার বিপরীত। এ অবস্থার পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক পাঁচ নির্দেশনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।
এই নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরকারি মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে ছাড়া, বড় বড় দেশীয় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তিতে প্রণোদনা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় দ্রুত পুঁজিবাজার সংস্কার, অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহ প্রদান। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাজারে কাক্সিক্ষত গতি ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে এ রকম উদ্যোগ নতুন নয়। অতীতেও পুঁজিবাজারের কারসাজি রোধে নানা ধরনের পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে সেসব উদ্যোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যেমন ২০১০-১১ সালের বাজার ধসের পরও নানা ধরনের সংস্কারের কথা উঠেছিল, তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছিল, কিন্তু কার্যকর শাস্তি বা কাঠামোগত পরিবর্তনের নজির খুবই কম। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও অবিশ্বাস গড়ে উঠেছে, যার প্রভাব বাজারে নগদ অর্থের ঘাটতি, টার্নওভারের নিম্নগতি এবং বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তায় স্পষ্ট।
গত এক দশকে পুঁজিবাজারে কিছু কাঠামোগত সংস্কার হলেও, বাস্তবিক অর্থে বাজারের গভীরতা ও পরিধি বাড়েনি। উন্নত অর্থনীতিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে বৃহৎ কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে, যা বাজারকে করে তোলে শক্তিশালী ও টেকসই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও বহু বড় কোম্পানি পুঁজিবাজারে না এসে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করে চলেছে। এতে ব্যাংক খাত যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনি পুঁজিবাজারও তার সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এ অবস্থায় বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা ও বাধ্যবাধকতাÑ দুটিই জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সদিচ্ছা প্রশংসার দাবিদার। তবে বাস্তবায়নই হবে মূল চাবিকাঠি। বিশেষ করে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভেতরের দুর্নীতি এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের চাপ- এসব বাধা অতিক্রম না করতে পারলে নতুন নির্দেশনাগুলোও অতীতের পুনরাবৃত্তি হয়ে উঠবে।
অতএব, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রধান উপদেষ্টা যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। এতে করে পুঁজিবাজার কেবল লুটেরাদের আখড়া নয়, বরং দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারে। আর সেটাই হবে অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ ও টেকসই বিকাশের অন্যতম ভিত্তি। পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেবল নির্দেশনা নয়, প্রয়োজন সময়মতো এবং কঠোর বাস্তবায়ন। এবারে যেন কথার চেয়ে কাজ বেশি হয়। পাশাপাশি বাজারে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ঠকবেন না- এই আশ্বাস তারা বাস্তবেই পান।