পুঁথিসাহিত্য সংরক্ষণ করতে হবে

রামিছা বিলকিছ জেরিন: পুঁথিসাহিত্য অতি পুরোনো বিষয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য একটি অংশজুড়ে রয়েছে পুঁথিসাহিত্য। এমন একসময় ছিল যখন ঘরে ঘরে ছিল পুঁথি। দিনের আলো নিভে গেলেই কুপি জ্বালিয়ে শুরু হতো পুঁথি পাঠ। পুঁথি পাঠকে ঘিরে সবাই জড়ো হতেন এবং মনোযোগ সহকারে শুনতেন। প্রাচীনকালে মূলত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষই ছিল পুঁথি অনুরাগী। তাদের লেখাপড়া বা ভাবনা চিন্তার পরিধি আটপৌরে হলেও অন্যরা যে একে অবহেলা করত, তা কিন্তু নয়। সেকালে পুঁথি ছিল সার্বজনীন। 

শিশু-কিশোর-বয়স্ক নির্বিশেষে সবার কাছেই পুঁথিসাহিত্যের অনুপম কাহিনী আখ্যানগুলো ছিল অমৃততুল্য। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার দাপুটে বাস্তবতায় প্রাচীন পুঁথিকাব্য, পুঁথি-কাহিনী বিস্মৃত ও বিলুপ্তপ্রায় হলেও আজও মানুষ ফিরে যেতে চায় স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলের সেই বিমূর্ত নান্দনিক স্টেশনে, যেখানে থাকে পুঁথিসাহিত্যের মিথ গল্পকথা, কল্পকাহিনী, লোকাচার, ধর্মকথা, রাজবন্দনা ইত্যাদি।

প্রাচীনকালে যখন ছাপাখানা ছিল না তখনও এদেশে পুঁথির প্রচলন ছিল। এই উপমহাদেশে ত্রয়োদশ শতকের আগে কাগজের ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার ১৭৭৮ সালের পূর্বে বাংলা ভাষার কোনো ছাপাখানাও এই তল্লাটে ছিল না। তবে কাগজ না থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে লিখনপদ্ধতি চালু ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে।

প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথিগুলো সাধারণত ভূর্জছাল, কাপড়ের পট, তালপাতায় লেখা হতো। তালপাতার পুঁথিগুলো বেশিরভাগই ছিল পূজার পুঁথি। মাদুলির মন্ত্রগুলো লেখা হতো ভূর্জছালে। মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্যভিত্তিক বিভিন্ন পুঁথিও লিখিত হতো তালপাতায়। তেরেট নামের তালজাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের পাতায়ও তখন পুঁথি লেখা হতো।

‘কবি মুকুন্দ রামের বাসভূমি দামুন্যায় তেরেট পাতায় লেখা ‘চন্ডীমঙ্গলের’ একটি পুঁথি সংরক্ষিত আছে’। (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-প্রথম খণ্ড-সুকুমার সেন। চতুর্থ সংস্করণ-১৯৬৩। কোলকাতা। পৃ. ৫১৪)। তবে ‘হরিতালী কাগজ’ নামে পরিচিত তুলট কাগজে লেখা পুঁথি তখন বেশ সমাদৃত ছিল। কাব্য সাহিত্য-ধর্মী পুঁথিগুলো এ ধরনের দুলট কাগজে লেখা হতো। এ কাগজ যত মজবুত হতো, লেখাও তত সুন্দর দেখাত।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুঁথিসাহিত্যের নতুন সূচনা হয়। ছাপাখানার প্রসারের ফলে। এ সময় থেকে হস্তলিখিত পুঁথির ব্যবহার ক্রমে লোপ পেতে থাকে এবং এর জায়গা দখল করে নেয় মুদ্রিত পুঁথি। এ সময় কলকাতার শোভাবাজারকেন্দ্রিক বিশেষ ধরনের পুঁথি বা বটতলার পুঁথির প্রচলনের ফলে ‘পুঁথি’ শব্দটি বিভ্রান্তির শিকার হয়।

পুঁথি সাধারণত দু’ধরনেরÑ১. কবির হস্তলিখিত মূল রচনা ও ২. লিপিকারের অনুলিপি। প্রথম ধরনের পুঁথি এখন আর পাওয়া যায় না। লিপিকারের অনুলিপি নিয়েই আমাদের পুঁথির জগৎÑযা থেকে বটতলার পুঁথি বা ছাপানো পুঁথির উদ্ভব। পুঁথির বিষয়বস্তু নানা ধরনের হতে পারে যেমন কাব্যসাহিত্য, চরিতকাব্য, মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ, সাহিত্য, ধর্মকথা, নবীকাহিনী, জঙ্গনামা ইত্যাদি।

মূলত ‘পুঁথি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পুস্তক’ থেকে। তবে প্রাকৃত ‘পুথিয়া’, হিন্দি ‘পোথী’, অসমীয়া ‘পুথি’, ফরাসি ‘পুস্তিন’ ও যে বাংলা ‘পুঁথি’ বা ‘পুঁথি’ শব্দের প্রচলনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেনি এমন বলা যাবে না। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি যদিও লিখিত সাহিত্য, তথাপি এর প্রস্তুতিকর্মের প্রতিটি পর্যায়ে লোকায়ত উদ্যোগ দৃষ্টিগ্রাহ্য হতো। পুঁথির ভেতরের প্রতিটি পাতা চার দিকে মার্জিন রেখে সাজানো হতো, যাতে পৃষ্ঠা ওল্টানো মাত্রই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়। খুব সুন্দর গোছানো লিখিত পুঁথি আজও বিস্মিত করে।

প্রাচীন পুঁথিতে উভয় পৃষ্ঠায় লেখার রেওয়াজ ছিল। তবে কাগজ খুব পাতলা হলে উভয় পৃষ্ঠায় না লিখে কাগজ দুই ভাঁজ করে উভয় পাশে লেখা হতো। পুঁথির পত্রাঙ্ক প্রতি পৃষ্ঠায় না লিখে সাধারণত পাতার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা হতো। আবার এমন পুঁথিও দেখা গেছে, যেগুলোতে লিপিকার পত্রাঙ্ক নির্দেশ করত না। পুঁথির দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, অলঙ্করণ, ভুলত্রুটি সংশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা চিহ্নের প্রয়োগ হতো। প্রাচীন পুঁথির পাতাগুলো ধারাবাহিকভাবে একের এক সাজানো, আলগা ও সেলাইবিহীন ছিল বিধায়, সেগুলোকে কাঠের পাটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতো। এক্ষেত্রে শাল বা সেগুন কাঠের পাটা ব্যবহƒত হতো। এছাড়া কোনো কোনো পুঁথির বহিরাবরণ হিসেবে চামড়ার খোলের ব্যবহারও চোখে পড়ত।

এসব চামড়ার আবরণে বাইরের দিকে পুঁথির বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা নকশা বা চিত্র খোদাই বা অঙ্কিত করা হতো, ভেতরের দিকে নানা ধরনের লতাপাতার চিত্র থাকতো। ধারণা করা হয়ে থাকে, সতেরো শতকের লোক শিল্পের প্রভাব এসব চিত্র পরিস্ফুট।

আরবি এবং বাংলা অক্ষরেও পুঁথি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা। যতীন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ গ্রন্থে আরবি হরফে লেখা বাংলা পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। আঠারো-উনিশ শতকে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিকশিত ‘নাগরী লিপিতে’ প্রচুর পুঁথি লিখিত হয়েছে। নাগরী লিপিতে পুঁথি লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑশীতালং শাহ্, আরকুম শাহ্, শাহনুর শাহ্, ইরফান আলী, ভেলা শাহ্, মুহাম্মদ খলিল, আবদুল কাদির শাহ্, ওয়াহেদ আলী শাহ্, আছদ আলী, মুন্সী সাদেক আলী, মুন্সী আবদুল করিম, ছৈয়দুর রহমান, শাহ আরমান আলী, দীন ভবানন্দ প্রমুখ।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন হচ্ছে পুঁথি। এ কারণে সুদূর অতীত থেকেই পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা করা হয়। এদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম পুঁথি সংগ্রহে হাত দেন কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক। তাদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণের আদি রচয়িতা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) অন্যতম। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১২টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, যা পরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেন। এর মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, চন্ডীমঙ্গল ও কালিকামঙ্গল উল্লেখযোগ্য। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বাংলা হরফ নির্মাতা চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৬ সালের দিকে ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ নামে দুটি পুঁথি সংগ্রহ করেন।

হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিচার্ড জনসন ১৮০৭ সালে এদেশ থেকে সংগৃহীত ১৪টি বাংলা পুঁথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রদান করেন। তার পুঁথিগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশীরাম দাশের ‘মহাভারত’ লোচন দাশের ‘দুল্লভসার’ ‘চৈতন্যতত্ত্বসার’ ও ‘নামসংকীর্ত্তন’। ১৭৯৩ সালের নভেম্বর বঙ্গদেশে আসেন উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)। তার নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগার কেরি লাইব্রেরি) এ খ্রিষ্টান মিশনারিগণ ৩ হাজারেরও বেশি বই ও হস্তলিখিত পুঁথি দান করেন। সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯২১ সালে সংগৃহীত পুস্তক তালিকায় আমরা ৫১টি বাংলা পুঁথির নাম পাই। মনসার ভাসান, চন্ডী, জৈমুনী ভারত, চৈতন্য মঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি পুঁথি।

১৯৬৮ সালে সরকারি প্রচেষ্টায় এদেশে প্রথমবারের মতো পুঁথি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি। এই কাজে প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয় রাজেন্দ্র লাল মিত্রকে ও পরো হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহচর্যে অনেক দুষ্প্রাপ্য বাংলা পুঁথি সংগৃহীত হয়। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি বিবরণীতে এ ধরনের ৩৬৭টি পুঁথির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বভারতী বিভিন্ন ভাষার পুঁথি সংগ্রহের কাজ করে। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের এক হিসাবে দেখা যায়, সময় পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে ১৪৩৯টি বাংলা পুঁথি ছিল চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আজীবন পুঁথি সংগ্রহ করেন। তিনি প্রায় সহস্রাধিক পুঁথি আবিষ্কার করেছেন এবং এসব পুঁথি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। তার আবিষ্কৃত পুঁথি নিয়ে তিনি প্রায় ৬ শতাধিক প্রবন্ধ লিখে প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করেন তার সংগৃহীত পুঁথির মধ্যে রয়েছে আবদুন নবীর ‘আমীর হামজা’, শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলায়খা’ সৈয়দ সুলতানের ‘ওফাত-ই’, ‘কেয়ামত মোহাম্মদ খানের নামা’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ (১৭৭৭), আলী রেজা ওরফে কানু ফকিরের ‘জ্ঞান সাগর’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (লিপিকাল-১৮৭৮), মোহাম্মদ খানের হানিফার লড়াই (১৭২৪), দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লি মজনু’ (১৮২৯), ‘দৌলত চন্দ্রানী’, (লিপি-১৭৫৪), ফকির গরীবুল্লাহর ‘সোনাভান’, ‘সতীময়না লোর’ ইত্যাদি। তার সংগৃহীত ৫৮৫টি মুসলিম বাংলা পুঁথি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন। তার সংগৃহীত ৩৩৮টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষক ড. এনামুল হক গবেষণার প্রয়োজনে কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন।

এভাবেই বিভিন্ন জন বিভিন্ন উপায়ে পুঁথি সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমান প্রজšে§র কাছে পুঁথি কীÑএসবের কোনো ধারণাই নেই হয়তো। ধীরে ধীরে এটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে জনমন থেকে। তাই অতীত বর্তমানের সেতুবন্ধনের প্রয়োজনে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসমুখের খোঁজে, আমাদের শিকড়ের সন্ধানে ধূলিমলিন আস্তরণ থেকে এসব খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এসব পুঁথির সংরক্ষণ, আরও পুঁথি সংগ্রহ এবং পুঁথির ব্যাপক চর্চা ও গবেষণা প্রয়োজন।

শিক্ষার্থী, ইসলামি শিক্ষা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়