শেয়ার বিজ ডেস্ক: গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গত সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া গত বছরের ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা বেশি নির্ধারণ করে দিতেন বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে। এমনকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হওয়া শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার লড়াই করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এটি বাংলাদেশে অধিকার-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে। কঠিন এই লড়াইয়ে জয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে। কাঠামোগত এমন সংস্কার করতে হবে, যা ভবিষ্যৎ সরকারের যে কোনো দমন-পীড়নকে প্রতিরোধ করতে পারে।’
‘আফটার দ্য মনসুন রেভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে যেÑঅতীতে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেনÑজুলাই-আগস্টের গণবিদ্রোহের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেই এসেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অস্থিরতার সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠ পর্যায়ের অফিসারদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারাই বেশি নির্ধারণ করে দিতেন।’ অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সিনিয়র অফিসারদের লাইভ সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেখেছেন এবং প্রতিবাদকারীদের গুলি করার জন্য অফিসারদের সরাসরি এমনভাবে নির্দেশ দিতে দেখেছেন যেন ‘তারা কাউকে ভিডিও গেমে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’ অন্য একজন অফিসার বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কঠোর হতে এবং ‘নৈরাজ্য ছড়ানো কোনো অপরাধী’কে রেহাই না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা স্পষ্টভাবে ‘গুলি করো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলি স্পষ্ট ছিল: সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, আপনি যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিন।’
তিনি এইচআরডব্লিউকে বলেন, আন্দোলনের সময়কার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন, যিনি জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তিনি বুঝতে পেরেছেন। অন্য একজন বলেছেন, ‘আমি অফিসারদের আন্দোলনকারীদের অত্যাবশ্যক ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখেছি… অনেক ক্ষেত্রে, অফিসারদের জীবন বিপদে না থাকলেও আমি তাদের তাজা গোলাবারুদ ব্যবহার ও গুলিবর্ষণ করতে দেখেছি।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে। এইচআরডব্লিউ জুলাই এবং আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দায়ের করা আটটি ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) পর্যালোচনা করেছে, যার মধ্যে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসহ ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি রয়েছেন ৬০০ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বাধার কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধের বিরক্তিকর পরিচিত প্যাটার্ন পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে, আর এবার সেটি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের লক্ষ্য করে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘উদাহরণস্বরূপ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রথম দুই মাসে হত্যা, দুর্নীতি বা অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে কয়েক হাজার লোকের বিরুদ্ধে, প্রধানত আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক হাজারের বেশি পুলিশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের চার শতাধিক মন্ত্রী ও নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় অভিযোগকারীরা জানতেন না কাদের আসামি করা হচ্ছে।’ আটটি মামলার পাঁচজন বাদী এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তারা মামলা দায়ের করার সময় আসামি হিসেবে কাকে নাম দেয়া হয়েছিল তা তারা জানেন না। তারা বলেন, পুলিশ বা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তাদের কাগজপত্রে সই করতে বলেছেন।
দুই বাদী এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাদের পুলিশ রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে বলেছিলেন, যদিও তারা নিশ্চিত নন যে তারা কার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপুলসংখ্যক ‘অজ্ঞাত’ লোকের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক অভিযোগ দায়ের করে চলেছে। এর মাধ্যমে কার্যত পুলিশকে প্রায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে এবং বারবার আটক ব্যক্তিদের পুনঃগ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেয় যদিও তারা কোনো মামলায় আসামি না হয়েও থাকে।’
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, মনসুন বা বর্ষা বিপ্লবের সময় হাসিনা সরকারকে নিজেদের রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সমর্থন করার জন্য পুলিশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত, কর্তৃপক্ষ বর্ষা বিপ্লবের বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্য কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে। এইচআরডব্লিউ আমজাদ হোসেন এবং নিজাম উদ্দিন নামে দু’জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সাথেও কথা বলেছে, যারা ছাত্র বিক্ষোভের সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন এবং ছাত্র বিক্ষোভকারী ওয়াসিম আকরামকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।
আমজাদ হোসেন এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, ‘সেদিন (১৬ জুলাই) আমরা কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ওয়াসিমের মরদেহসহ আরও তিনজনের লাশ নিয়ে সাহায্য করছিলাম যারা বিক্ষোভের সময় নিহত হয়েছিলেন। এমনকি আমরা জানাজার জন্য মৃতদেহ নিতেও পরিবারকে সাহায্য করেছি। যখন আমি ওয়াসিম হত্যা মামলার তালিকাভুক্তদের মধ্যে আমার নাম খুঁজে পাই, আমি হতবাক হয়ে যাই। সেদিন আমি হাসপাতালেই ছিলাম এবং এত এত হতাহত ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে আসায় বাড়তি সময়ও ডিউটি করেছিলাম। আমি কখনোই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। এখন আওয়ামী লীগের অনেক লোকের সঙ্গে আমার নাম খুঁজে পাচ্ছি আমি। পুলিশের সাথে যোগাযোগ করার সাহস পাইনি। আপনি পুলিশকে জানেন। আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে থানায় গেলে, আমার কথা শোনার আগেই তারা আমাকে গ্রেপ্তার করবে।’
এইচআরডব্লিউ’র এই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন প্রয়োগের তত্ত্বাবধানে থাকা কর্মীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এছাড়া প্রসিকিউশন এবং বিচার বিভাগ যাতে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্যও সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা।