এক্সপ্রেসওয়েতে বেড়েছে দুর্ঘটনা

পুলিশের তদারকি নেই, সাইন সংকেতও গতানুগতিক

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ: ভোরে সড়কে প্রচন্ড কুয়াশা ছিল। ২০-৩০ ফুট দুরের কিছুও ভালো করে দেখা যাচ্ছিলো না। আমাদের পাশ দিয়ে সাই সাই করে ট্রাক, মোটরসাইকেল, বড় বড় যাত্রীবাহী বাস যাচ্ছিলো। আমাদের প্রাইভেটকারটি আস্তে আস্তে সড়কের একপাশ ধরে ঢাকার দিকে এগোচ্ছিলো। সে সময় হঠাৎ করে একটি ট্রাক আমাদের গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। গাড়ির ক্ষতি হলেও ছোট তিন বাচ্চাসহ আমরা ৭ জন একেবারে অক্ষত ছিলাম।

গাড়ি থেকে নেমে মাসি, চালক ও আমাদের আরো কয়েকজন ট্রাকের চালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কুয়াশার সময় কেনো বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো হলো জানতে চাইলে। সে (ট্রাকচালক) বলছিলো প্রাণে বেঁচে আছেন সেটার শুকরিয়া আদায় করেন। সে সময় আরো একটি বেপরোয়া ট্রাক এসে সামনের ওই ট্রাকের পেছনে ধাক্কা মারে। সামনের ট্রাকটি মাসিসহ কয়েকজনে উপরে উঠে যায়। ঘটনা স্থলেই মারা যান আমার মাসি।

কথাগুলো বলছিলেন, সোমবার ভোরে এক্সপ্রেসওয়েতে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় নিহত পান্না বণিক (৩৫) এর বোনের মেয়ে তুষি ঘোষ। নিহত পান্না বনিক কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার বসাকপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
তুষি ঘোষ বলেন, প্রায় আধাঘন্টা আমার মাসি ট্রাকের চাকার নিচে পড়েছিল।কেউ উদ্ধার করতে আসেনি।আমাদের অন্য আহতরাও ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। আধাঘন্টা পর পুলিশ আসে। এর পর তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। পরে মাসিসহ ৬ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তুষি অভিযোগ করে বলেন, শীতের সময় কুয়াশা থাকবে স্বাভাবিক।গাড়ি চালানো বন্ধ থাকবে না। যদি মহাসড়কে পুলিশের বেশি বেশি নজর দারি থাকতো বেপরোয়াভাবে কেউ গাড়ি চালাতনা। বেপরোয়া গাড়ি না চললে হয়তো প্রাণহানীর মত ঘটনাও ঘটতো না।
জানা যায়,বৈরী আবহাওয়ায় সড়ক, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের ন্যূনতম গতিসীমা মানা হচ্ছে না। কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় সামনের কিছু একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো একেবারে বন্ধ রাখার কথা বলা আছে; কিন্তু সেই নির্দেশনা কেউ মানছেন না। এ জন্যই ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে গত দুই দিন একাধিক যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
সড়ক সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত সোমবার ও আগের দিন রোববার মুন্সিগঞ্জে এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা মহাসড়কটির সাইন-সংকেতব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। এর আগে যমুনা সেতু চালুর পর সেতুটির আগে-পরে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার ধরন হচ্ছে, ঘন কুয়াশার কারণে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে পেছন থেকে একের পর এক যান এসে ধাক্কা দেয়। একে ‘পাইল আপ’ বলে। এ জন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।

এদিকে, গেল রোববার ভোরেও এক্সপ্রেসওয়ের হাসারা এলাকায় কুয়াশার মধ্যে বেপরোয়া গতিতে নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাসারা এলাকার ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার জায়গায় ৪টি স্থানে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ডভ্যানসহ ১০টি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসব গাড়ি কোথাও সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা দেয়। কোথাও একটি গাড়ি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দেয়।এ সব দুর্ঘটনায় মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে গাড়ির এক চালক মারা যান।

শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস ও হাসাড়া হাইওয়ে থানা সুত্রে জানা যায়,শুধু তাদের হিসেবেই গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৬৩টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮০জন আহত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫ জন নারীসহ ১৬ জন।যার মধ্যে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই মারা গেছে ৪ জন।

শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, আমরা দুর্ঘটনার সময় সড়কে গিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে যতজন হতাহতের নাম নিতে পেরেছি শুধু তাদের সংখ্যাই আমাদের কাছে আছে। এর বাইরে এমনও দুর্ঘটনা ঘটেছে যেগুলো আমরা যাওয়ার আগেই সেখান থেকে হতাহতরা চলে গেছেন। যে কারণে তাদের তথ্যটা আমাদের কাছে নেই। এই কারনে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। তার মতে, এসব দুর্ঘটনা ঘন কুয়াশায় ফগ লাইট না জ্বালানোর কারণে, ট্রাফিক আইন না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের গাফলতি, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র গাড়ি থামানো, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় বের করার কারনে ঘটেছে। এসব ঘটনা রাতের আধারে, ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির মধ্যে বেশি হয়েছে। ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালানো, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষিত করা ও যাত্রীরা সচেতন হলেই এই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
হাসারা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) আব্দুল কাদের জিলানী বারবার সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে বলেন, যে দুটি রোববার ও সোমবার যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে দুটোই ভোর বেলা ঘটেছে। আর এ সময় অতিরিক্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে এক্সপ্রেসওয়ে।দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে। সড়ক আইন মেনে যদি চালকরা গাড়ি চালাতেন তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না।

এদিকে মঙ্গলবার বেলা তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা থেকে শুরু করে শ্রীনগর উপজেলার হাঁসাড়া পর্যন্ত ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে পুলিশের কোন গাড়ি দেখা যায়নি। সড়কের কোথাও পুলিশের কোন অবস্থানও চোখে পড়েনি। এসময় সড়কের চলাচলরত যানবাহনের গতিসীমা কোথাও প্রতি ঘণ্টায় কোথাও ৪০, কোথাও ৬০,কোথাও ৮০ কিলোমিটার লেখা থাকলেও গাড়ির চালকরা তা অমান্য করে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন।
হাসাড়া এলাকার প্রদ্বীপ দাস ও হুমায়ুন আহমেদ জানান, কুচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী সেতুর টোলপ্লাজা, হাসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানা এলাকার কাছাকাছি এক্সপ্রেসওয়েতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নাম মাত্র টহল দেয়। এ টহলে এক্সপ্রেসওয়েতে কোনভাবে দুর্ঘটনা কমাতে পারবেনা।

মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেন, বেপরোয়া চালক ও পরিবহনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আইনি কার্যক্রম চলছে। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। এছাড়াও দুর্ঘটনা রোধে প্রতিনিয়ত আইনের মাধ্যমে জরিমানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।