মাজহারুল ইসলাম শামীম: পৃথিবীতে মহাদেশ সাতটি, এ তথ্য সবার জানা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, আরেকটি মহাদেশ লুকিয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে। সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকা অষ্টম মহাদেশ জিল্যান্ডিয়া।
ইতিহাস অনুসারে, ১৭৬৯ সালের জানুয়ারিতে জেমস কুক যখন কেপ হর্ন প্রদক্ষিণ করেন এবং এইচএম বার্ক এন্ডেভার জাহাজে করে প্রশান্ত মহাসাগরে যাত্রা শুরু করেন, তখন তার প্রধান কাজ ছিল ভেনাস গমনের পথ খুঁজে বের করা। কিন্তু তার ওপর আরেকটি দায়িত্বও বর্তেছিলÑদীর্ঘদিন যাবৎ অনুমিত দক্ষিণাঞ্চলীয় মহাদেশ টেরা অস্ট্রেলিস ইনকগনিটা আবিষ্কার করা। ছয় মাস নিউজিল্যান্ডের উপকূল ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ানোর পর ১৭৭০ সালে তিনি পশ্চিমে জাহাজ ভেড়ান। ততদিনে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেছেন, যে মহাদেশটিকে তিনি খুঁজছেন, এটি তার অংশ নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন সর্বৈব ভুল, এমনই দাবি করেছেন ভূবিজ্ঞানী নিক মর্টিমার ও হামিশ ক্যাম্পবেল, তাদের রচিত ‘জিল্যান্ডিয়া: আওয়ার কনটিনেন্ট রিভিলড (তবধষধহফরধ: ঙঁৎ ঈড়হঃরহবহঃ জবাবধষবফ)’ গ্রন্থে। তারা বলেন, এ মহান আবিষ্কারক ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ টেরা অস্ট্রেলিস ইনকগনিটা ছিল তার জাহাজের কাঠামোর নিচেই লুকিয়ে। অথচ তিনি তা টেরই পাননি! মানে হলো, মহাদেশটি ছিল পানির নিচে নিমজ্জিত এবং সেই পানির নিচে নিমজ্জিত মহাদেশ জিল্যান্ডিয়াকেই অনেকে দাবি করেন অষ্টম মহাদেশ হিসেবে। খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যপূর্ণ এই জিল্যান্ডিয়া পরিচিত নিউজিল্যান্ড মহাদেশ বা তাসমান্টিস নামেও।
জিল্যান্ডিয়া আকারে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সমান। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, জিল্যান্ডিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই এ মহাদেশের নাম দেয়া হয়েছে নিউজিল্যান্ড ও ইন্ডিয়া দুই দেশ মিলিয়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিউজিল্যান্ড আসলে এই মহাদেশেরই জেগে থাকা অংশ।
জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেন, জিল্যান্ডিয়ার আয়তন ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা অস্ট্রেলিয়ার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান। কিন্তু এই মহাদেশের প্রায় ৯৪ শতাংশই তলিয়ে আছে সাগরের পানিতে। মাত্র অল্প কিছু অঞ্চল পানির ওপর মাথা তুলে আছে, যেমন নিউজিল্যান্ডের নর্থ ও সাউথ আইল্যান্ড এবং নিউ ক্যালেডোনিয়া। মহাদেশের স্বীকৃতি পেতে যা দরকার, জিল্যান্ডিয়া তার সবই পূরণ করেছে বলেও দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। এখন তারা চেষ্টা করছেন নব আবিষ্কৃত তলিয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের জন্য মহাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের।
জিল্যান্ডিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আট দশমিক পাঁচ ধারণা করা হয়, দুই দশমিক তিন কোটি বছর আগে সম্পূর্ণ মহাদেশটিই নিমজ্জিত ছিল। মানচিত্র দেখে বোঝা যায়, অষ্টম মহাদেশ জিল্যান্ডিয়ার মাঝের একটি ছোট অংশই শুধু ডুবে যায়নি। আর ওই জেগে থাকা অংশই এখনকার নিউজিল্যান্ড দেশ। নিউজিল্যান্ডের গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএনএস সায়েন্স এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। ১৯৯৫ সাল থেকেই জিল্যান্ডিয়া মহাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন তারা। ২০১৭ সালে গবেষণা সম্পূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রটি তুলে ধরতে পারেননি তারা। এবার সমুদ্রের অতলে লুকিয়ে থাকা অষ্টম মহাদেশের নানা তথ্য সামনে এসেছে।
জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান সম্পর্কে জানতে এর টেকটোনিক ও ব্যাথিমেট্রিক নকশা প্রস্তুত করেছেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা। তাদের অনুমান, সেই মহাদেশের আয়তন ছিল ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটারের মতো। কিন্তু এর মাত্র ছয় শতাংশ পানির ওপরে দৃশ্যমান।
প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় তিন হাজার ৮০০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে এই মহাদেশ। যদিও লর্ড হাউ রাইজে বলস পিরামিড নামে ওই মহাদেশের একটি পাহাড় সমুদ্রের ওপরে বেরিয়ে রয়েছে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, সমুদ্রের ভেতরে একটা বড় ভূখণ্ড ডুবে রয়েছে। সেটাই জিল্যান্ডিয়া। অনেকের মনে হতে পারে, জিল্যান্ডিয়ার সিংহভাগ অংশ পানির নিচে নিমজ্জিত থাকায় তাই এটির মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত যোগ্যতা নেই। পানির ওপরে অবস্থিত হওয়া মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা আসলে ভুল ধারণা।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে, কোনো বিশাল ভূখণ্ডের মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মূলত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজনÑক. আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে উঁচু হতে হবে; খ. সুস্পষ্ট কিছু ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে; গ. সুনির্দিষ্ট সীমারেখা থাকতে হবে এবং ঘ. সমুদ্র তলদেশের চেয়েও পুরু ভূস্তর থাকতে হবে। অবশেষে ভূবিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, জিল্যান্ডিয়ার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই এটি মহাদেশ হিসেবে ঘোষণা পাওয়ার যোগ্য।
শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ