পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ আলু-সবজিতে অস্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক : রোজার ঈদের আগে একই দামে কিছুদিন থাকার পর এবার লাগামহীনভাবে বাড়ছে পেঁয়াজ ও আলুর দাম। মাসের ব্যবধানে কেজিতে পেঁয়াজের দাম পাইকারিতে হয়েছে দ্বিগুণ; খুচরায় বেড়েছে আরও বেশি, সপ্তাহান্তে ১০ থেকে ১৫ টাকা লাফ দিয়ে ঠেকেছে ৭০ টাকায়।

রান্নার আরেক নিত্যপণ্য আলুর দামও মাস ঘুরে বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা; বিক্রি হচ্ছে আকার ও বাজারভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। এ সময়ে সবজি কিনতে গিয়েও পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়তি টাকা।

শীত মৌসুমে বাজার করতে গিয়ে শুধু সবজিতে মিলেছিল স্বস্তি। গরম পড়ার মধ্যে রোজা শুরু হলে সব ধরনের সবজির দাম কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। এখন তা আরও বেড়ে ক্রেতাদের জন্য ‘অস্বস্তির’ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কেজিপ্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা দাম বেড়েছে। গ্রীষ্মের অনেক সবজির কেজিই মিলছে না ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে।

খিলগাঁও বাজারে বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আয়নাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে লাগামহীনভাবে জিনিসের দাম বাড়ছে। গত সপ্তাহে পেঁয়াজ নিলাম ৫৫ টাকা আজ বলতেছে ৬৫ টাকা। মাছ-মাংসের দাম তো অনেক বাড়তি। এখন সবজির বাজারে গেলেও অস্বস্তিতে পড়া লাগে। আপনি ঝিঙে, ধুন্দল, করলা, কাঁকরোল, বরবটি, ঢ্যাঁড়স, চিচিঙ্গা যা-ই কিনতে চান; ৯০ থেকে ১০০ টাকা আপনার দেয়া লাগবে।’

গতকাল রাজধানীর মিরপুর ও কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু-পেঁয়াজ-সবজির মতো বাজারের ফর্দে নিয়মিত থাকা আদা-রসুনের দামও বাড়ছে তরতরিয়ে।

এদিকে সরকার চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও কোনো প্রভাব নেই খুচরা বাজারে। এখনও আগের মতোই প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। খোলা চিনি পাওয়া গেলও দাম নেওয়া হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি; যদিও সরকার তা ১২০ টাকা ঠিক করে দিয়েছে।

গতকাল মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকায় ছোট আকারের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজিদরে। আকারে একটু বড় পেঁয়াজের কেজি ৭৫ টাকা।

এ বাজারের পেঁয়াজ-আলু বিক্রেতা মো. ইব্রাহিম বলেন, দাম তো গত সপ্তাহেও ৫৫ টাকা ছিল। বড়টা ছিল ৭০ টাকা। আড়তে পেঁয়াজের অভাব নেই কিন্তু দাম বাড়তি। আমরা তো আর জিজ্ঞেস করি না কেন বাড়তি। বাজারে যে দর চলে সে দরেই কিনে আনি। এখন একটা যুক্তি হইছে দাম বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেই আমদানি না থাকা, ডলারের ক্রাইসিসÑ এগুলোর কথা বলে।”

রোজায় যেখানে আলু বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজিদরে সেখানে খুচরায় তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজিদরে।

তরকারি বেশি ব্যবহার হওয়ায় এ নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় অসুবিধায় পড়ার কথা জানালেন সীমিত আয়ের মানুষ। কাজীপাড়া বাজারে রিকশাচালক মো. মোতালেব বলেন, ‘আলু কিনলাম ৩৫, পেঁয়াইজ ৬০ ট্যাকা, মুরগি কিনলাম ২৬০ ট্যাকা। আদা-রসুনের দামও বলতি। সারাদিন রিশকা বাইয়া যে ট্যাহা পাই এইডা দিয়া সংসার চালাইয়া, বাজার সদাই কইরা পুষে না তো।’

এ বাজারের বিক্রেতা মো. হাবিব বলেন, আলুর আমদানি

কমে গেছে, এজন্য আড়তেই দাম বেশি। আমরা কেজিতে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন টাকা লাভ করি।”

বাজারে আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আদা-রসুনের দামও। গত সপ্তাহেই আভাস মিলেছিল আদার দাম বেড়ে যাওয়ার। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ঈদের পর মানভেদে কেজিপ্রতি ইন্দোনেশিয়ার আদা কেজিতে ১৫০ টাকা বেড়েছে, মিনায়মারেরটি ১০০ ও চীনা আদার দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। মিয়ানমারের আদা বাদে কোনোটিই ৩২০ টাকার নিচে মিলছে না। মিয়ানমারের আদার দাম ২২০ টাকা। অথচ টিসিবির তথ্যে গত বছর এ সময়ে আদা ৮০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেছে।

দাম বেড়েছে আমদানি করা রসুনেরও। কারওয়ানবাজারে চীনা রসুন কেজিপ্রতি দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে।

এদিকে দেশের অন্যতম সবজি সরবরাহকারী জেলা বগুড়ায় সাত দিন আগে যেখানে পটোলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৬০ টাকা সেখানে এ সপ্তাহে তা হয়েছে ৮০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০ টাকা, সজনে ৪১ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৪০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ টাকা ও কাঁচামরিচ ১৬০ টাকা।

উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ সবজি বাজার মহাস্থান কাঁচা বাজারের আড়তদার নভেল জানান, ‘এক মাস আগেও দাম এত বেশি ছিল না। গরমে দেশি সবজি নষ্ট হয়েছে। তাই দাম বেড়েছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে সবজির ফলন কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে।’

ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরবরাহ কমে যাওয়ার ব্ড় ধরনের প্রভাব পড়েছে সব ধরনের সবজির দরে। বছরজুড়ে সবার সাধ্যের মধ্যে থাকা পেঁপেরও দাম নাগালের বাইরে, বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিদরে; গ্রীষ্মকালীন অন্য সবজির কেজিও ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই।

সরবরাহ সংকটের কথা বলে কিছু সবজির দাম অনেক বেশি নেয়ার তথ্যও মিলছে। বগুড়ায় সজনে যেখানে ৪০ টাকা, সেখানে ঢাকার বাজারে তা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ বগুড়ায় ১৬০ টাকা হলেও ঢাকায় তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়।

কারওয়ানবাজার ও শাহ আলী বাজারের সবজি বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। তবে এসব যুক্তিতে ব্যাগ ভরছে না ক্রেতাদের। তারা প্রকাশ করছেন উষ্মা।

মিরপুরের শাহ আলী পাইকারি বাজারে সকালে বাজার করতে এসে হতাশা প্রকাশ করে সদ্য অবসরে যাওয়া সরকারি চাকরিজীবী আবদুল হাই বলেন, ‘পেঁপে যদি ৮০ টাকা হয় তাইলে আমরা কই যাব। পেনশন আর কয় টাকা। সবজি কোনোটা ৮০-৯০ টাকার নিচে নেই। করলা ১০০, একটু সজনে নিতে চাইলাম- আরে বাবা সে তো প্রায় ১৫০ টাকা কেজি। আগে বাজারের ব্যাগ টানতে কুলি লাগত এখন ব্যাগ অর্ধেকও ভরে না।’

মিরপুরের শাহ আলী পাইকারী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গ্রীষ্মের সবজি পটোলের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, পেঁপে ৮০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৮০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, কাঁকরোল ১০০ টাকা, সজনে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দাম বাড়তি লাউ ও কুমড়ারও। বাজারে গতকাল মিষ্টিকুমড়ার কেজি গেছে ৪০ টাকা, জালি কুমড়া ও লাউ এক পিস ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গাজরের কেজি চড়ে গেছে ১০০ টাকায়। একই টাকার কমে মিলবে না কচুর লতিও।

আগের মতোই চড়া অন্য পণ্য: বাজারে ডিম, মুরগি ও সয়াবিন তেলের দামও অনেক দিন থেকে ঊর্ধ্বমুখী। ব্রয়লার মুরগি আগের মতোই প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালি মুরগি কিনতে গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। মুরগির বাদামি ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। সাদা ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। গত এক সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি মাছ-মাংসের বাজারেও।

তবে বাজারে বোরো ধানের চাল ঢুকতে শুরু করায় কমতির দিকে মোটা ও মাঝারি চালের দাম। তবে আগের মতোই আছে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চালের দাম।

এদিকে সরকারের ঘোষিত নতুন দরের আগেই চিনি বিক্রি হচ্ছিল ১৩৫-১৪০ টাকায়। তখন সরকার দাম ধরে দিয়েছিল খোলা ১০৪ এবং প্যাকেট ১০৯ টাকা। এরপর বৃহস্পতিবার দাম বাড়িয়ে কেজি প্রতি ১৬ টাকা বাড়িয়ে খোলায় ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এতেও বাজারে পরিবর্তনের নজির নেই। এখনও খোলা চিনি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়ই বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট চিনি এখনও দোকানগুলোতে দৃশ্যমান নয়।