খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা এবং সার্বভৌম নগররাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির সরকারপ্রধান পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে কাসা সান্টা মার্টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ইস্টার সানডে উপলক্ষে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে বহু প্রত্যাশিত উপস্থিতির একদিন পর ৮৮ বছর বয়সে মারা গেলেন পোপ ফ্রান্সিস। ভ্যাটিকানের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে কার্ডিনাল কেভিন ফ্যারেল বলেছেন, ‘প্রিয় ভাই ও বোনেরা, গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাকে আমাদের পবিত্র পিতা ফ্রান্সিসের মৃত্যুর ঘোষণা দিতে হচ্ছে। রোমের বিশপ ফ্রান্সিস সোমবার সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে মারা যান। তার সমগ্র জীবন ছিল প্রভু এবং তার গির্জার সেবায় নিবেদিত।’
চলতি বছরের শুরুতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফ্রান্সিস দু’বার মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। গত ২৩ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড় পাওয়ার আগে তাকে সেখানে ৩৮ দিন থাকতে হয়েছিল।
পোপের মৃত্যু শোকের আবহ বয়ে এনেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তার মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়েছেন। ভ্যাটিকান সিটির প্রশাসন এক ভিডিও বার্তায় তার মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স এক শোক বার্তায় বলেন, ‘এই মাত্র পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। রোববার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন বলে তা আর হয়নি। তাকে সবসময় আমার মনে পড়বে।’
ভাইস প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘করোনা মহামারির শুরুর দিনগুলোতে গোটা বিশ্ব যখন আতঙ্কে অস্থির, সে সময় তিনি প্রতিদিন আমাদের শান্ত থাকার জন্য যেসব ধর্মপোদেশ দিতেন, তা আমি কখনও ভুলব না। তার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মতো আমার হƒদয়ও ভারাক্রান্ত।’
পোপ ফ্রান্সিসকে ‘একজন মহান ব্যক্তি এবং মহান নেতা’ উল্লেখ করে এক শোক বার্তায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সান্নিধ্যে আসার, বন্ধুত্ব অর্জনের। যে উপদেশ, যে শিক্ষা আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি, জীবনের কঠিনতম সময়ে সেসব ছিল আমার পাথেয়।’
এক শোক বার্তায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন, ‘যতদিন তিনি পোপ ছিলেন, সবসময় তিনি দুর্বল ও অসহায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার বিনম্র, নিরহঙ্কারপূর্ণ আচরণের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। যুদ্ধ ও সহিংসতায় পরিপূর্ণ এই বিশ্বে তিনি সারাজীবন দুর্বল, নিপীড়িতের কথা চিন্তা করেছেন, তাদের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি পোপ ফ্রান্সিসকে নম্রতা, সহানুভূতি এবং আধ্যাত্মিক সাহসিকতার বাতিঘর উল্লেখ করে এক শোক বার্তায় বলেন, ‘তিনি নিরলসভাবে দরিদ্র ও নিপীড়তদের সেবা করে গেছেন। দুঃখ-কষ্টে থাকা লোকজনের মনে আশার আলো জাগিয়ে তুলতেন তিনি। তার সঙ্গে আমার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সেসব বৈঠকে তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষম উন্নয়ন ইস্যুতে যেসব কথা বলেছিলেন, সেসব সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং ভবিষ্যতেও দেবে। ভারতের জনগণের প্রতি তার ভালোবাসা আমরা সবসময় স্মরণে রাখব। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।’
জর্মানির সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্জ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় বলেছেন, ‘সমাজের সবচেয়ে দুর্বল-অসহায় লোকজনের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি ছিল তার। নিজেকে চিরদিন বিশ্বাস ও বিনম্রতার সঙ্গে নিজেকে চিরদিন ঈশ্বরের করুণার পথে চালিত করেছেন তিনি।’
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইসাক হেরজগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক শোক বার্তায় বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং সীমাহীন সহানুভূতিসম্পন্ন একজন মানুষ। দরিদ্রদের উন্নয়ন এবং অশান্তিপূর্ণ বিশ্বের শান্তি স্থাপনের জন্য গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য তিনি যত প্রার্থনা করেছেন, আমি সত্যিই চাই তার সেসব প্রার্থনা যেন সফল হয়।’
ফিলিপাইনের শীর্ষ ধর্মযাজক এবং কার্ডিনাল পাবলো ভিরিগিলিও ডেভিড বলেন, ‘ওহ ঈশ্বর! আমি (তার মৃত্যুতে) বিহ্বল, শোকস্তব্ধ।’ ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দি হোলি সি’-এর তথ্যমতে, পোপ ফ্রান্সিসের আগের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। জš§ ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সের। বাবা মারিও আর রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক।
রসায়নবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ধর্মের পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরবর্তী সময়ে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সাল ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও বার্গোগ্লিও। পোপ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ফ্রান্সিস’। আর্জেন্টিনার এ ধর্মযাজক দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতার জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন।