নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের তৈরি পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা। তারা বলেছেন, আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি মোটেও ভালো মজুরি নয়। আর কত দিন এ মজুরি থাকবে, বর্তমানে সেটাই জরুরি প্রশ্ন।
গতকাল মঙ্গলবার তৈরি পোশাক খাতের পরিবেশবান্ধব রূপান্তরকে টেকসই করার বিষয়ে আয়োজিত এক সংলাপে তারা এসব কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এ সংলাপ আয়োজন করে।
সংলাপে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রধান অতিথি ছিলেন। অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে ও ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি।
প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম, বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ডেপুটি হেড থিজ উডস্ট্রা।
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমাদের এখন শোভন মজুরি ও তা নিশ্চিতে ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ মজুরি বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি সাধারণ পরিবারের জন্য আট হাজার টাকা মোটেও ভালো মজুরি নয়। মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্যোক্তা ও সরকারের পাশাপাশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের উপপ্রধান থিজ উডস্ট্রা বলেছেন, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশকে ন্যূনতম মজুরির ফাঁদ থেকে বের হতে হবে। এ অবস্থায় দেশের পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আর কত দিন পর্যন্ত আট হাজার টাকা থাকবে, বর্তমানে এটিই জরুরি প্রশ্ন।
অনুষ্ঠানে থিজ উডস্ট্রা আরও বলেন, প্রবৃদ্ধির মডেল নিয়ে বাংলাদেশের আবার চিন্তা করা প্রয়োজন। এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। ফলে বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের পোশাক খাতের ৪৫ লাখ শ্রমিকের কথা চিন্তা করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই।
এদিকে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বস্বীকৃত সবুজ কারখানার সনদ পেয়েছে বাংলাদেশের শতাধিক পোশাক কারখানা। ফলে বড় কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে ৯৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর চিকিৎসা খরচ কমেছে ৮৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
২০২২ সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালে ৪০৩ ফ্যাক্টরি থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত ও চার হাজার ৫৪১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে থেকে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় প্রতিষ্ঠানে সবুজায়নের পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বড় কারখানার ৯৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে, ৮৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ চিকিৎসা খরচ কমেছে। অন্যদিকে কারখানা ও কর্মচারীদের কর্মক্ষমতা যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ ও ৯৫ দশমিক ০৭ শতাংশ বেড়েছে। বড় ফ্যাক্টরির মুনাফা বেড়েছে ৩৪ দশমিক ০৯ শতাংশ।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে সবুজায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ৮১ দশমিক ৫৪ শতাংশ স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমেছে, ৬৫ দশমিক ২ শতাংশ চিকিৎসা খরচ কমেছে। অন্যদিকে কারখানা ও কর্মচারীদের কর্মক্ষমতা যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ও ৭৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এই ধরনের ফ্যাক্টরির মুনাফা বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সবুজায়নের পদক্ষেপ নেয়ার ফলে মাইক্রো কারখানার ৮৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ স্বাস্থ্যঝুঁকি কমেছে, ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ চিকিৎসা খরচ কমেছে। অন্যদিকে কারখানা ও কর্মচারীদের কর্মক্ষমতা যথাক্রমে ৬৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও ৭৫ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। মাইক্রো ফ্যাক্টরির মুনাফা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, তদারকি, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়সহ নানা কারণে পোশাক কারখানায় সবুজায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অনেক কারখানার বিভিন্ন ধরনের সবুজায়ন সার্টিফিকেট নিয়েছে। এর পাশাপাশি দেখছি লিড একটা সার্টিফিকেশন আছে, যেটা ইউএস জিএফের অধীনে হয়ে থাকে। সেটার মধ্যে এনার্জি, ওয়াটার, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, কেমিক্যাল ওয়েস্টÑএই সবই আছে। সেই সার্টিফিকেট প্রায় ২০০ কারখানা নিয়েছে, আর ৪০০-৫০০ পাইপলাইনে আছে।
তিনি বলেন, আমরা যখন বায়ারদের সঙ্গে কথা বলেছি, তখন শুনছি তাদের চাহিদা ভিন্ন। সবুজের সংজ্ঞা, সূচক ভিন্ন এই সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে। সেখানে এক ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। এই চাহিদাগুলো যদি একীভূত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে রপ্তানিকারকদের সুবিধা হয়। একেক রপ্তানিকারকের চাহিদা একেক রকম, লিডকে অনেক বায়ারই স্বীকার করতে চায় না। তার মানে আরও প্রস্তুতি নিতে হবে।
বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, আমাদের সবুজ কারখানা গ্লোবাল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আমার মনে হয়, সিপিডিকে অন্যান্য দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। পোশাক কারখানা এরই মধ্যে তীব্র নজরদারির মধ্যে রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০-এর অধিক সবুজ কারখানা আমাদের আছেÑ৭৩টি প্লাটিনাম রেটিং, ১৫০টি গোল্ড, ১০টি সিলভার রেটিং। বিশ্বের সেরা ১৫টি লিড ফ্যাক্টরির ১৩টি বাংলাদেশে। পাঁচ হাজার ফ্যাক্টরি সবুজায়ন সার্টিফিকেট নেয়ার পথে আছে।
ব্যবসায়ী তাবিথ আউয়াল বলেন, আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া যতই সবুজ হোক না কেন, বের হওয়া পণ্যটি যদি সবুজ না হয়, এটা ভবিষ্যতে বড় সমস্যা সৃষ্টি করবে। ফ্যাশন কোম্পানিগুলোকে ২০৩০ সাল নাগাদ উৎপাদনের একটা অংশ রিসাইকেল টেক্সটাইল দিয়ে করতে হবে। আমাদের রিসাইকেল করা যায়, এমন বর্জ্যরে উৎসের প্রয়োজন। এটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বছরে ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপন্ন করে। আমরা যদি সেটা সংগ্রহ করতে পারি তাহলে রিসাইকল পণ্যে উৎপাদনের বড় সমস্যা সমাধান করতে পারব।