বীর সাহাবী: উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মধ্যে ডাক বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। দেশের জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য ডাক বিভাগই একমাত্র সরকারি ডাক সেবাদানকারী সংস্থা। এই সেবাদানকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জনগণকে ডিজিটাল সেবা দেয়ার নাম করে ১৬০ কোটি ২৯ লাখেরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি খাতে বিভিন্নভাবে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বা সিএজির ২০২৩ সালে প্রকাশিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তরের ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ শীর্ষক প্রকল্পের ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ক্রয় প্রক্রিয়া ও মনিটরিং কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বেশ কিছু অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেছে। মূল তিনটি ইস্যুর অধীনে মোট ১১টি অনিয়ম পাওয়া গেছে। যেগুলোর মাধ্যমে এই খাতে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের বড় একটি অংশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের পকেটস্থ করেছেন। সারাদেশে সাড়ে ৮ হাজার পোস্ট অফিসকে পোস্ট ই-সেন্টারের আওতায় আনা হয়েছে। এসব সেন্টার জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে অবস্থিত। প্রথমে একটি টিম দ্বারা ১৫০টি সেন্টার পরিদর্শন করা হয়, পরবর্তী সময়ে আরও ১২টি টিম গঠন করে ৭৫০টি সেন্টার পরিদর্শন করা হয়। মোট ৯০০টি ই-সেন্টার পরিদর্শন করা হয়, যা মোট ই-সেন্টারের ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করার ঘোষণা করে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মাঝে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেয়া ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। দেশের পোস্ট অফিসগুলোকে ডিজিটাল পোস্ট অফিসে রূপান্তর করার মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত বেগবান করার পাশাপাশি এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৮ হাজার ৫০০টি উপজেলা ও সাব পোস্ট অফিসের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বরাদ্দ দেয়া হয় ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা। তবে এই অর্থ থেকে প্রকৃত খরচ করা হয়েছে ৩৮০ কোটি ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। আর বাকি টাকা বিভিন্ন ভুয়া খাত দেখানোর মাধ্যমে এ প্রকল্পের আওতাধীন কর্মকর্তারা ১৬০ কোটি ২৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা লোপাট করেছেন। যে অর্থ বরাদ্দ ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নত সেবা পাওয়ার জন্য, সে অর্থ লোপাট করে কর্মকর্তারা তাদের পকেটস্ত করার মাধ্যমে দেশের আধুনিকায়নে প্রকৃতপক্ষে বাধা সৃষ্টি করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন।
সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনগণের সেবার মান উন্নয়নে সরকারের দেয়া বরাদ্দকৃত অর্থ এভাবে ভুয়া খাত দেখিয়ে লোপাট করা জনগণের অধিকার ক্ষুণœ করার মতো অপরাধ। এতে করে সরকারের যে ভিশন ছিল আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি দেশের মানুষের বড় একটা অংশ সরকারি সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
যেসব খাতে অর্থ তছরুপ: সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনটি ইস্যুতে মোট ১১টি ধাপে অনিয়ম ধরা পড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপ্রকল্পের উদ্দেশের সঙ্গে জড়িত ক্রয়ের উপযোগিতা মূল্যায়ন করা; প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না তা মূল্যায়ন করা এবং প্রকল্পের মনিটরিং ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা।
প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রপাতি ক্রয়: এই ইস্যুতে উঠে এসেছে কীভাবে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নয় এমন অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করার মাধ্যমে ৭ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার ২১৪ টাকা অপচয় করা হয়েছে। ৯০০টি ই-সেন্টারের মধ্যে ১৯৮টি ই-সেন্টার চালুই করা হয়নি। পাশাপাশি ই-সেন্টারের জন্য কেনা আসবাবপত্র না পাওয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থের অপচয় করা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন না করা: যেসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে সরকার এ প্রকল্প নিয়েছিল, সেসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি। এর মূলে বেশকিছু গাফিলতির কথা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এগুলো হচ্ছেÑ পল্লী জনগোষ্ঠীর মাঝে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ সেন্টর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পোস্টাল সেভিংস ব্যাংক ও পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কার্যক্রম প্রসারিত করতে সেন্টারগুলো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেয়া যেত, যা দেয়ায় ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতা বিতরণে ই-সেন্টারগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে ই-সেন্টারগুলো কোনো অবদান রাখতে পারেনি। পল্লী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রেমিট্যান্স সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ই-সেন্টারগুলো সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ ছিল, এতেও ব্যর্থ হয়েছে এবং পোস্ট ই-সেন্টারগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এভাবে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিভিন্ন সুবিধা থেকে পল্লী জনগোষ্ঠী সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রকল্পের মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ না করা: এ খাতটি বিশ্লেষণ করে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের উদ্দেশগুলো অর্জনের লক্ষ্যে যে প্রয়োজনীয় মনিটরিং করা দরকার ছিল সেই মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে করে যেসব জায়গায় পর্যাপ্ত মনিটরিং দরকার ছিল সেগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়নি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, উদ্যোক্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে তরুণ, সৃষ্টিশীল, কম্পিউটার জ্ঞানসম্পন্ন, প্রকৃত আগ্রহীদের উদ্যোক্তা নিয়োগ প্রদান করা হয়নি। ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো নষ্ট হলে উপজেলা পর্যায়ে মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে তাদের ডিভাইসগুলো ঢাকায় প্রেরণ করতে হয়, এতে সময় ও অর্থ উভয়ই অপচয় হয়। ই-সেন্টারগুলো পোস্ট অফিসের পরিবর্তে বিভিন্ন ভাড়া করা স্থানে পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে এখানে বাড়তি অর্থ অপচয় করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারে সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে ডাক অধিদপ্তরে কথা বলতে বলেন। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘আমি তো ২০১৮ সালে জয়েন করেছি, আর এই ঘটনা ২০১৭ সালের। আর এই ঘটনার কিছু জানতে চাইলে ডাক অধিদপ্তরে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তারাই ভালো বলতে পারবে।’
পরে ডাক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (ডাক সার্ভিস) এস এম শাহাব উদ্দীনকে ফোন দেয়া হলে তিনিও এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘এগুলো দেখার জন্য অন্য কর্মকর্তারা আছেন। আপনি পরিকল্পনা পরিচালক আবু তালেবের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তিনি আপনাকে এ ব্যাপারে যা জানতে চান তা বলবেন।’