সংকটে জেলেদের জীবন

প্রকল্প গিলেছে কোহেলিয়া নদী

এসএম রুবেল, কক্সবাজার: নুরুল কাদের পেশায় জেলে ছিলেন। তিনটা নৌকা ছিল তার। তার অধীনে কাজ করতেন আরও কয়েকজন জেলে। কোহেলিয়া নদীতে জাল বসিয়ে দলবেঁধে মাছ শিকার করতেন। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়েই তাদের সংসার চলত। জরাজীর্ণ ঝুঁপড়ি ঘরে চার সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তার বসবাস। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের জীবনে থেমে আসে অভাবের কালো ছায়া। থমকে যায় তার আদি পেশা। তিনি অর্থিক সংকটে পড়ে যান। ফলে নৌকাগুলো কেটে চুলোর লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। আর জালগুলো কিছু ঘেরাবেড়ার কাজে ব্যবহার করলেও অল্প কিছু পড়ে রয়েছে বাড়ির আঙিনায়।

জেলে নুরুল কাদেরের বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ইউনিয়নের উত্তর রাজঘাট দরগা পাড়া গ্রামে। গ্রামটি কোহেলিয়া নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে। কোহেলিয়া নদীই ছিল এই গ্রামের মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস।

নুরুল কাদের জানান, একসময় কোহেলিয়া নদীটির প্রাণ ছিল। নদীতে উৎসবমুখর পরিবেশে দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারে নামতেন তারা। কিন্তু ২০১৬ সালের পর নদীটি অস্বাভাবিক হারে ভরাট হয়ে এখন মৃতপ্রায়। এ নদী ঘেঁষে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের রাস্তা ও স্থাপনা তৈরি করায় কোহেলিয়া নদী ছোট হয়ে যায়। পাশাপাশি মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্যরে সঙ্গে মাটিও এসে পড়ে নদীতে। ভাটার সময় নদীর পানি প্রায় শুকিয়ে যায়। ফলে নদীতে আর জাল বসানো সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে জেলের পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি ও অনেক জেলে।

বাড়িতেই কথা হয় নুরুল কাদেরের স্ত্রী নুর আয়েশার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছি। জলাবদ্ধতার কারণে বর্ষা মৌসুমে বাড়িতে পানি প্রবেশ করে এবং বাড়ির আঙিনায় শাকসবজির চাষ করা যায় না। স্বামী কর্মহীন হয়ে পড়ায় ধারদেনা করেই নিদারুণ কষ্টে সংসার চালাচ্ছি। বিকল্প পেশা কিংবা আয়ের ব্যবস্থা না হলে চরম সংকটে পড়বে আমার পরিবার ও জেলে পরিবারগুলো।”

তিনি আরও জানান, বড় ছেলে আবু বক্কর নতুন বাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে জান্নাতুল বকেয়া ও তাসনুভা জান্নাত দক্ষিণ রাজঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে এবং অপর মেয়ে আফিয়া জান্নাত পড়ে নুরানী মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে। বিকল্প পেশা সৃষ্টি না হলে সন্তানদের পড়াশোনা চালানো দায় হয়ে পড়বে তাদের।

মাতারবাড়ী ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আলাউদ্দিন জানান, কোহেলিয়া নদীর পাশঘেঁষে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ ও উত্তর রাজঘাট নামের দুটি গ্রাম। গ্রামে প্রায় ১৭ হাজার মানুষের বসবাস এবং ভোটারসংখ্যা ছয় হাজারের অধিক। গ্রাম দুটির অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে জেলে পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

রফিকউদ্দিন মানিক ও সাকিব নামের দুই গ্রামবাসী জানান, কোহেলিয়া নদীর ওপর নির্ভর করে চলে পাঁচ শতাধিক জেলের পরিবার, যাদের মধ্যে ২৮৪ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন এবং বাকিরা অনিবন্ধিত। কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এসব জেলের পরিবারে আর্থিক মন্দা চলছে।

মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হায়দার বলেন, কোহেলিয়া নদীর ওপর নির্ভরশীল জেলেদের পুনর্বাসন ও বিকল্প পেশা সৃষ্টি কিংবা দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রকল্প হাতে নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।