Print Date & Time : 16 August 2025 Saturday 12:50 am

প্রকৃত মানুষ তৈরির কারখানাই চাইবো

এস এম নাজের হোসাইন: চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ভর্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা অনুসরণ না করে অতিরিক্ত ফি আদায়, পুনঃভর্তিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়, ছাড়পত্র দেওয়ার সময় পুরো বছরের ফি আদায়সহ নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে জেলা শিক্ষা অফিস ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিনিধি সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে। ভুক্তভোগী অভিভাবকদের সাক্ষ্য-প্রমাণে বেশিরভাগ অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ হয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও ১১টি প্রতিষ্ঠান তা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো চকবাজারের মেরিন সান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জামালখানের চিটাগাং আইডিয়াল স্কুল, চিটাগাং ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুল, হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মেরিট বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল, বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মির্জা ইস্পাহানি স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় পাহাড়তলী, এলিমেন্টারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অভিযোগ রয়েছে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটির সঙ্গে ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান দলটির নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিছু প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত এবং কিছু প্রতিষ্ঠান বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী পরিচালিত। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু গণমাধ্যম, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট ও এনজিও’র সহযোগিতায় এসব অভিযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান উৎসব, ভাষা উৎসব, বিতর্কসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এ ধরনের কর্মসূচি আয়োজনের খবরে গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবসহ বিভিন্ন নাগরিক অধিকারভিত্তিক সংগঠন। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বোর্ড চেয়ারম্যান, গণমাধ্যম ও সাংবাদিক নেতাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর অর্থ এ নয় কি, প্রকারান্তরে এ ধরনের অনিয়ম ও পুকুরচুরিকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন তারা? তারা কি জানেন না, অভিযুক্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে চাল-ডালের ব্যবসায়ীদের মতো সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে? এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে কোনো নিয়মশৃঙ্খলা মানতে আগ্রহী না হতে পারে। মানুষ হওয়ার বদলে অমানুষ হতে পারে। এটি দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। একসময় বলা হতো মাদ্রাসায় জঙ্গি বানানো হয়। আর এখন জঙ্গি বানানোর অভিযোগ উঠছে প্রগতিশীল ও আধুনিক বলে পরিচিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মনজুরুল ইসলাম এক লেখায় বলেছেন, শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় সংকটের কারণে কিছু শিক্ষক নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা অবশ্য ঠিক। তবে এ সংখ্যা বেশি নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শিক্ষাব্যবসায় ঢুকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজাচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের নিয়োগপত্র দিচ্ছে না। তারা চাকরি করছেন প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা মালিকের মর্জির ওপর। একসময় জমিদার কিংবা শিক্ষাবিদরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তেন। স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থের জোগান দিতেন। এখন চাল, ডাল, মাছের ব্যবসায়ীরা ৮-১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ‘শিল্পপতি’ সাজতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তারা সততা ও নৈতিকতার চর্চা করবেন। মিথ্যা ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেন না। কিন্তু ভর্তিবাণিজ্য ঠেকাতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও ক্যাবের কর্মসূচিতে দেখা গেছে, অর্থ আদায়ে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথাকথিত প্রধানরা সঠিক তথ্য প্রদানে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানপ্রধান যে তথ্য দিচ্ছেন, তার সঙ্গে অভিভাবকদের তথ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে একটু নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে অভিভাবকরা তাদের কাছে জিম্মি, টু-শব্দ করার সাহস নেই। স্কুল পরিচালনায় অভিভাবকদের অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।
একশ্রেণির মানুষ প্রায়ই ‘এদেশে কিছু হবে না’ বলে মন্তব্য করেন। আশার কথা, বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ যদি সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন, তাহলে তাদের শিক্ষার্থীদেরও সত্যিকারের মানুষ না হয়ে বিপথগামী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একসময় শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ ছিল। শিক্ষকদের কঠোরভাবে মেনে চলতো শিক্ষার্থীরা। এখন উপদেশ দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন না শিক্ষকরা। শিক্ষক নিজেই যদি সততা ও নৈতিকতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করেন, তাহলে কেন তাদের উপদেশ বিনা বাক্যে মেনে নেবে শিক্ষার্থীরা? উপদেশ নয়, দৃষ্টান্তই কাম্য।

অনেকে বলেন, শিক্ষায় নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। ইদানীং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী শপথবাক্য পাঠ করানো হচ্ছে। এটির প্রবর্তক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ-টিআইবি। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই যেখানে দুর্নীতি ও অনিয়ম করছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের দুর্নীতিবিরোধী শপথ পাঠ করানো কতটা যুক্তিসংগত এটি ভাবার সময় এসেছে। শিক্ষকরা দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় তাদের উপদেশ শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসছে না। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের পচন পুরো শিক্ষাকে শুধু কলুষিত করেনি, অধিকন্তু জাতি গঠন ও শিশুর মনন বিকাশে বিশাল প্রতিবন্ধক। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন শুধু ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে তা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে না প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং, নোটবই বাণিজ্যসহ নানা নীতিহীন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাই শিক্ষার পচনরোধে অভিযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিকভাবে বর্জন করা উচিত। তাহলেই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি জঙ্গিবাদ ও অনিয়মমুক্ত আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে, যেখানে সত্যিকার অর্থে মানুষ তৈরি হবে। না হলে বিশাল বিশাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রকৃত মানুষ তৈরির বদলে অমানুষ তৈরির কারখানায় পরিণত হবে, যা টাকা বানানোর মেশিন ছাড়া আর কিছু হবে না।

ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন
অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
nazer.cabbd-gmail.com