প্রগ্রেসিভ লাইফের আর্থিক তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি!

রাহমান আরিফ: ব্যবসায়িকভাবে পিছিয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স। মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, আইনি জটিলতা, আর্থিক তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তিসহ বেশ কয়েকটি কারণে বিপাকে রয়েছে কোম্পানিটি। আইনি জটিলতায় প্রতি বছর আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না কোম্পানিটি। যে কারণে অস্বচ্ছ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করছেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে বিমা দাবি পেতে গ্রাহকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে; যা কোম্পানিটিকে আরও পেছনে ফেলছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যবসায়িকভাবে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ২০১৯ সালের সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটি ৬০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা গ্রস প্রিমিয়াম আয় করেছে বলে জানিয়েছে। এরপর থেকে কোম্পানিটির আয় কমছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোম্পানিটির আয় ও জীবন বিমা তহবিলের তথ্য নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যের সঙ্গে প্রগ্রেসিভ লাইফের তথ্য মিলছে না।
অন্যদিকে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে কোম্পানিটির গ্রস প্রিমিয়াম আয় ছিল ৪২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা; যার কিছুটা বেড়ে পরের বছরে ৪৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা হয়েছিল। এরপর থেকে টানা আয় কমছে কোম্পানিটির। ২০২৪ সালে প্রগ্রেসিভ লাইফের গ্রস প্রিমিয়াম আয় কমে ৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রগ্রেসিভ লাইফের প্রিমিয়াম আয় প্রায় ১০ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কমেছে। অথচ কোম্পানির দায়িত্বশীলরা প্রিমিয়াম আয় বাড়ছে বলে দাবি করে আসছেন। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন না থাকায় সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল আমিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসা বাড়াতে কাজ করছি। বিশেষ নজর দেয়ার কারণে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় বাড়ছে। আমরা আগের চেয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছি। আগামী জুনে আর্থিক প্রতিবেদনে সেই চিত্র দেখা যাবে।’
তথ্যমতে, ২০২১ সালে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চলমান পলিসি ছিল ২১ হাজার ৫০টি। ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চলমান বিমা পলিসির সংখ্যা ২১ হাজার ৯০৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়Ñবলে মনে করছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এক সভায় কোম্পানিটিকে চলমান পলিসির সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে আইডিআরএ।
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জীবন বিমা তহবিলের সঠিক পরিমাণ নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য মিলেছে। ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সেই বছরে কোম্পানির জীবন বিমা তহবিলে প্রায় ২৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ছিল; যা তার আগের বছরের তুলনায় এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা বা শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে কোম্পানিটির জীবন বিমা তহবিলে প্রায় ২৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ছিল বলে দাবি করা হয়েছে।
যদিও বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ একই বিষয়ে ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। সংস্থাটির এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে প্রগ্রেসিভ লাইফের জীবন বিমা তহবিলে প্রায় ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ছিল। এক বছর পর ২০১৮ সালে এসে কোম্পানিটির জীবন তহবিল কমে মাত্র ৪৮ লাখ টাকায় নেমে আসে। অর্থাৎ এক বছরে ব্যবধানে ওই তহবিল প্রায় ৯৯ দশমিক ৮২ শতাংশ কমে যায়। আর ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিক শেষে তহবিলের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ টাকা।
সূত্রগুলো বলছে, কোম্পানিটি জীবন বিমা তহবিলের টাকা বিষয়ে তথ্য গোপন করেছে। আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে অতিরঞ্জিত তথ্য তুলে ধরেছে। আর ২০১৯ সালের পর থেকে বার্ষিক সাধারণ সভা ও প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় প্রকৃত তথ্য পাচ্ছে না সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বিমার গ্রাহকরা।
প্রগ্রেসিভ লাইফের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনেও কোম্পানিটির আর্থিক তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিল নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান এম এম রহমান অ্যান্ড কোং। যদিও জীবন বিমা তহবিল তলানিতে নেমে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে চাননি কোম্পানিটির দায়িত্বশীলরা।
প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল আমিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যকে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে। বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিসংখ্যানে কী বলা হয়েছেÑসেটা আমি জানি না। জীবন বিমা তহবিলে অর্থের বিষয়ে আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যকেই সঠিক বলে ধরতে হবে।’
আইনি জটিলতায় এজিএম করতে না পারায় ২০২০ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না প্রগ্রেসিভ লাইফ। আগের ছয় বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে এজিএম করেছে কোম্পানিটি। সেই সময় প্রতি বছরের জন্য গড়ে সাড়ে ১২ শতাশ পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। শুধু ২০১৫ সালের জন্য বাড়তি পাঁচ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, সাধারণ বিমা খাতের কোম্পানি প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ৭৫ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট এক কোটি ৬৬ লাখ শেয়ারের অর্ধেকই এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রগ্রেসিভ লাইফের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে প্রগ্রেসিভ লাইফের ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ার ছিল; যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমেছে। একইভাবে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের সংখ্যাও কমেছে।
মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পাল্টাপাল্টি মামলা, ব্যবসায়িকভাবে পিছিয়ে পড়া ও নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় প্রগ্রেসিভ লাইফ নিয়ে সংশয় বাড়ছে। সে কারণেই আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানিটির শেয়ারের দর বৃদ্ধির সময় সুযোগ বুঝে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে সরে যাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৮ জুলাই প্রগ্রেসিভ লাইফের শেয়ার দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে ৩২ টাকা এক পয়সা সর্বনি¤œ দর ছিল ২০২৪ সালের অক্টোববের শেষ সপ্তাহে। ক্ষমতার পালাবদলের চলতি বছরের শুরু থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ছে।