Print Date & Time : 18 August 2025 Monday 9:29 pm

প্রচলিত মতবাদগুলোর মুখোশ উম্মোচন

মিজানুর রহমান শেলী: চার্লি আর আমি অনেক দিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একটি আজীবন মেয়াদি বিনিয়োগ করব। কেননা একটি বিনিয়োগে শত শত স্মার্ট সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আসলে কষ্টকর। এই সিদ্ধান্তের ফলে বার্কশায়ারের পুঁজি বিনিয়োগ অনেকটাই ভুঁইফোঁড় হয়ে উঠল। এমনকি বিনিয়োগের এই সার্বজনীনতায় আমাদের ওপর দারুণ প্রভাব পড়ল, নাটকীয়ভাবে সবকিছু যেন সংকুচিত হয়ে পড়ল। তাই আমরা নতুন একটি কৌশল বের করলোম। এই কৌশলে আমাদের স্মার্ট হতে হলো। তবে এমন খুব বেশি মাত্রার স্মার্টনেস নয়, যা মানুষ মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে। কার্যত এখন থেকে আমরা একটি বছরের জন্য একটি ভালো কৌশল বা পরিকল্পনা উদ্ভাবন করে থাকি।
চার্লি বলে এটা আমার ফিরে আসা: আমাদের এই উদ্ভাবিত কৌশলে আমাদের অনুসরণীয় বৈচিত্র্যময় মতবাদগুলোকে নিবৃত্ত করে দিল। তাই অনেক পণ্ডিত এ বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে বসলেন। তারা বললেন, এই নতুন উদ্ভাবিত কৌশলটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেবে। এর চেয়ে প্রচলিত কৌশলাদি ছিল কম ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা অবশ্য এসব কথায় কান দিলাম না। কার্যত দ্বিমত পোষণ করলাম। আমরা বিশ্বাস করি পোর্টফোলিও কনসেন্টেশনের নীতিটি নিতান্ত উপকারী। এটা ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে যদি এটা একজন ব্যবসায়ীর চিন্তাকে লালন করতে পারে খুব নিবিড় আর নিকট থেকে, একই সঙ্গে এটা যদি ক্রয়ের আগেই ব্যবসাটির স্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রাটি ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে। কার্যত এ উভয় কাজটিই একই সঙ্গে সম্পন্ন করে নেওয়া উচিত। এই মতামত বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা ঝুঁকিকে সংজ্ঞায়িত করি। এক্ষেত্রে আমরা আভিধানিক অর্থ ব্যবহার করে থাকি: ‘ক্ষতি বা আঘাতের আশঙ্কা’।
তবে একাডেমিক পর্যায়ের পণ্ডিতরা বিনিয়োগ ঝুঁকিকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পছন্দ করে থাকেন। তাদের সংজ্ঞায় তারা একটি স্টক বা কোনো স্টকের পোর্টফোলিওর আপেক্ষিক অবিশ্বাসকেই গুরুত্বারোপ করেছে। তাদের এই অবিশ্বাস সার্বজনীন স্টকগুলোর বড় পরিসরের তুলনাযোগ্য বলে মনে করেন। ডেটাবেজ ও পরিসংখ্যানিক দক্ষতা ব্যবহারের মাধ্যমে এসব একাডেমিক হিসাব-নিকাশে স্টকের ‘বেটা’ ব্যবহারে যথার্থতা থাকে। এর সঙ্গে থাকে আগের আপেক্ষিক অবিশ্বাসযোগ্যতা। এরপরে গোপন বিনিয়োগ ও পুঁজি বণ্টন তত্ত্বকেও ব্যবহার করা হয়। ঝুঁকি পরিমাপে তাদের একক পরিসংখ্যানের প্রতি আকৃষ্টতায় তারা মৌলিক নীতিগুলোকে ভুলে যায়। আসলে একবারে ভুল হওয়ার চেয়ে মোটামুটি ভালো বা সঠিক হওয়াই উত্তম।
একটি ব্যবসায়ের মালিকদের জন্য ঝুঁকির একাডেমিক সংজ্ঞা তার ব্যবসার ব্যবহারিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। আর যেহেতু একটি ব্যবসার মালিকের পথ আর তার শেয়ারহোল্ডারদের পথ একই, তাই এ কথাটি যেমন মালিকদের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষেত্রেও সত্য। কেননা এসব একাডেমিক সংজ্ঞায়নের আসলে কোনো মানে হয় না। এগুলো কেমন অর্থহীন অকর্মণ্য বক্তব্যই তৈরি করে। ব্যবসার ব্যবহারিক কর্মে নতুন নতুন সংকট সমাধা করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, বেটাভিত্তিক তত্ত্বের আওতায় একটি স্টকের কথা বলা যায়, যা বাজারের তুলনায় খুব খাড়াভাবে অধঃপতিত হয়। যেমন ওয়াশিংটন পোস্টের কথা বলা যেতে পারে। আমরা এটা ১৯৭৩ সালে খরিদ করেছিলাম। এ সময় ওয়াশিং পোস্ট ছিল খুব ঝুঁকির মধ্যে। কার্যত এর যখন রমরমা অবস্থান তার থেকে ১৯৭৩ সালের অবস্থান ছিল একেবারেই নি¤œ।
এ ঘটনার বিবরণীটি বাস্তব। এখানে সমগ্র কোম্পানিটিকে একেবারেই অধঃপতিত অল্প মূল্যে খরিদ করা হয়েছে। কিন্তু যে কেউ কি এমন করে কোনো ধসে পড়া কোম্পানির সব ব্যবসাকে খরিদ করতে চাইবে? কিন্তু বার্কশায়ার যখন তা করেছে, তার উদাহরণ একজনের মনে কেমন বোধ সৃষ্টি করতে পারে? সে বিষয়ে চিন্তার সুযোগ থাকে।
কার্যত, একজন সত্যিকার বিনিয়োগকারী সবসময়ই অবিশ্বাস আর ঝুঁকিকে স্বাগত জানায়। বেন গ্রাহাম ব্যাখ্যা করেছেন এ বিষয়ে। বিষয়টি নিয়ে বিষদ আলোচনা থাকছে এই ইন্টেলিজেন্ট ইনভেস্টর বইয়ের অধ্যায় আটে। এখানে ‘মিস্টার মার্কেট’কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মিস্টার মার্কেট এখানে একজন বাধ্যগত ছাত্র যে প্রতিদিন দেখায় হয় তোমার কাছ থেকে খরিদ করো অথবা তোমার কাছে বিক্রি করে দাও। এক্ষেত্রে তোমার স্বাধীনতা রয়েছে, যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই তুমি করতে পার। এখানে মিস্টার মার্কেট একজন খেদ উš§ত্ত বিষণœ লোক। যেখানে বিনিয়োগকারীর কাছে যত বেশি সুযোগ সৃষ্টি হয় লোকটাও তত বড় মহান হয়ে ওঠে। এটা সত্য। কেননা বাজার কোনো নিয়ম না মেনেই ওঠানামা করেÑমিস্টার মার্কের যেন এখানে এক বন্য লোক। তবে এর অর্থ হলো অযৌক্তিকভাবে নি¤œ দাম পর্যায়ক্রমে নির্ভরযোগ্য আসল ব্যবসায় পরিবর্তিত হয়। পালা পাল্টে নেয়। কিন্তু এ ধরনের দাম কীভাবে একজন (হয় বাজার অবজ্ঞাকারী অথবা তার বোকামি আত্মসাৎকারী) বিনিয়োগকারীর ব্যবসায় কার্যক্রমে নানাভাবে বাধা ও বিরক্তি সৃষ্টি করে এবং নিয়মিত তা বাড়তেই থাকে তার উপস্থিতি নিজ চোখে দেখার বিষয়টি চিন্তা করাও বেশ কষ্টসাধ্য।
ঝুঁকি মূল্যায়নে একজন বেটা ব্যবহারে পরিশুদ্ধ জ্ঞানী লোক অবশ্যই কোম্পানি কী কী পণ্য উৎপাদন করে তা এড়িয়ে চলবে। কিন্তু ওই কোম্পানির প্রতিযোগীরা ঠিকই কোম্পানিটির উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। এমনকি তারা এটা বিশ্লেষণ করে থাকে যে, কোম্পানিটি তার ব্যবসায় পরিচালনায় বা পণ্য উৎপাদনে কোথা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। আবার ওই বেটা বিশেষজ্ঞ কোম্পানিটির নাম জানার ক্ষেত্রেও কোনো আগ্রহ দেখাতে নাও পারে। কোম্পানির নাম জানাটাও কার্যত তার কাছে নিষ্প্রয়োজনীয় ব্যাপার। আসলে কোম্পানিটি যে অর্থ আহরণ করে বা লাভের ফসল ঘরে তোলে তাই হলো কোম্পানিটির স্টকের মূল্য ইতিহাস। বিপরীতে, আমরা এসব বিষয়ে খুব আগ্রহী হয়ে থাকি। আমরা খুব স্বপ্রণোদিত হয়েই কোম্পানির মূল্য ইতিহাস বা নথি জানার জন্য অগ্রবর্তী হয়ে থাকি। এমনকি কোম্পানি সম্পর্কে এমন আর কী কী তথ্য রয়েছে, যা আমাদের ওই কোম্পানি সম্পর্কে জানা-বোঝা ও উপলব্ধির জন্য সহায়ক হতে পারেÑতার অনুসন্ধান চালিয়ে থাকি। সে যে তথ্যই হোক ছোট কিংবা বড়, গুরুত্বহীন বা গুরুত্ববাহী তার সবকিছুকেই আমরা সম্মান করি। একটি স্টক আমাদের কেনা পরে, ধারাবাহিকভাবে, তাই আমরা কখনোই বিরক্তি বোধ করি না। যদি সে কোম্পানির অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়ে যায়, এমনকি কোম্পানিটি যদি দুই বা এক বছরের জন্য বন্ধ হয়েও থাকে তাতে আমরা অনুতাপ করি না। বিরক্ত হই না।

এই দর্শন রচনাবলি সম্পাদনা করেছেন লরেন্স এ. কানিংহ্যাম।
অনুবাদক: গবেষক, শেয়ার বিজ।