মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শেষ সময় পর্যন্ত এ ছয় মাস মূলত মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু খরা, তাপপ্রবাহ, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় জলাশয়ে কম পানির কারণে এ বছর মাছের প্রজনন মৌসুমে পর্যাপ্ত রেণু পোনা উৎপাদন হয়নি যশোরের হ্যাচারিগুলোয়। সেইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেননি ক্রেতারাও। যে কারণে কাক্সিক্ষত পোনা ও রেণুু বিক্রি করতে পারেননি যশোরের চাঁচড়ার হ্যাচারি মালিক ও পোনা বিক্রেতারা।
দক্ষিণের জেলাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় দিন দিন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যশোর অঞ্চলের মৎস্য চাষের ওপর। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের মাঝের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন মাছ চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
মাছ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিকট-অতীত যে কোনো সময়ের চেয়ে চলতি মৌসুমে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিগত কয়েক বছর এমনিতে করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশ বেগে পেতে হয়েছে। করোনা চলে যাওয়ার পর গত মৌসুমে তারা বেশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও ছিল তাদের। কিন্তু এ বছর জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে তাদের ব্যবসা শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
শহরতলির চাঁচড়ার মৎস্যপল্লির মাতৃফিশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, মাছের প্রজনন মৌসুমের রেণু ও পোনা উৎপাদনের মৌসুম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শেষ সময় পর্যন্ত এ ছয় মাস মূলত মাছের প্রজনন মৌসুম। তবে এ বছর কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পুরো সময়টা আমাদের অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। তিনি বলেন, মাছ উপযোগী সময় জুলাই মাসে বেশিরভাগ পুকুরেই পানি ছিল না। যে কারণে মৌসুম শুরুর ৫ মাসে রেণু পোনা বিক্রি একেবারেই কম ছিল। আগস্টে বৃষ্টি হওয়ায় বেচাকেনা বাড়লেও মাছের প্রজনন কমে যায়। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পোনা ও রেণু সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
মাছের পোনা বিক্রেতা রবিউল ইসলাম রবি বলেন, আগে যশোরের ৮২টি হ্যাচারিতে ২ লাখ ৬০ হাজার রেণু উৎপাদন হতো। অথচ এখন তা বন্ধ হতে হতে ৩৫টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে এখন উৎপাদন আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে গেছে। অনাবৃষ্টি, খরা ও তাপমাত্রাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মাছ চাষ ফেলে অনেকেই অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। যে কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এ অঞ্চলের মাছ চাষ। তিনি বলেন, যশোর থেকে চট্টগ্রাম এলাকায় বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাশের রেণু ও পোনা সরবরাহ হলেও এ বছর বৃষ্টির অভাবে ওইসব এলাকা থেকে কোনো ব্যবসায়ী আসেননি। যে কারণে মাছ চাষিরা কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েন। এখন ওইসব এলাকায় বৃষ্টি হওয়ায় কিছু ক্রেতা এলেও উৎপাদন বন্ধ থাকায় রেণু ও পোনা দিতে পারছি না।
শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকার বাসিন্দা ইদ্রিস আলী বলেন, ছোটবেলা থেকে মাছের রেণু ও পোনা বিক্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মৌসুম এলে তিনিসহ অন্য চাষিরা মিলে কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি এলেও এ বছর সীমিত বেচাকেনার মধ্যে দিয়েই মৌসুম শেষ করতে হয়েছে। এমন দুর্দিন আর আগে কখনও আসেনি তাদের।
রুপালি ফিশ হ্যাচারি মালিক শেখ মেজবাহ উদ্দীন বলেন, মৌসুম কখন আসে আর কখন যায় এটা বলা মুশকিল। মাছ চাষও শতভাগ সেচনির্ভর হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, জলবায়ুর রূপ বদলানোর কারণে আমরা যারা মাছ চাষ করি তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। তারপর বিদ্যুৎ খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগাড় করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে আরও পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে চলে গেলে মাছ চাষে যশোরের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, তা হারিয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত এপ্রিল ও জুনে বৃষ্টি হলে নদী, খাল ও পুকুরে পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে দেশীয় মাছ খাল-বিল ও নদীতে প্রাকৃতিকভাবে ডিম ছাড়ে ও প্রজনন করে। কিন্তু এ বছর এ অঞ্চলে এই দুই মাসে বৃষ্টি না হওয়ায় খাল-বিল ও পুকুর, জলাশয়ে পানি জমেনি। যে কারণে মাছ চাষের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরও জোরালো এ অঞ্চলের মাছ চাষ আরও ঝুঁকিতে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছে।