ইয়াছিন আরাফাত: তরুণরা হলো বর্তমান পৃথিবীর ভবিষ্যৎ প্রতিচ্ছবি। তরুণদের নিয়ে দেশ, জাতি, বিশ্ব এক সোনালি যুগের স্বপ্ন দেখে। তারা এমন এক সমাজের কর্ণধার হবে, যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানবতার অপার কল্যাণ। যে সমাজে থাকবে না মানুষে মানুষে কোনো হিংসা, মারামারি, কাটাকাটি, অশ্লীল-বেহায়াপনা, অনৈতিক কোনো কার্যকলাপ। তারাই আলোকিত করবে অন্ধকারে ডুবে থাকা এই জাহেলি সমাজকে। তারাই নিয়ে আসবে এক সোনালি সূর্যের প্রভাত, যার অস্ত যাওয়া হবে কল্পনাতীত।
কিন্তু যে তরুণরা আঁধারের বুকচিরে আনবে প্রভাত, ঠুঠাবে সকল তিমির রাত, বাঁধার সব পাহাড়। তারাই যদি সে আঁধারের মেলায় হারিয়ে যায়, তাহলে কে বা দেখবে এই সত্য সমাজের স্বপ্ন? কে বা ধরবে এই তিমির সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া নৌকার” হাল? কে বা ছুটে আসবে সমাজ পরিবর্তনের সুর শোনাতে এই জাতির ভাগ্যের? নিচে তুলে ধরব তরুণদের ‘ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যৎ’-এর পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্য সুন্দর বর্ণনা।
তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের প্রধান কারণ ‘অসজ্জনে’ সঙ্গদান। সমাজ বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, মানুষ একাকী কোনো খারাপ কাজে ততটা তৎপর হয় না, যতটা তৎপর হয় সঙ্গী-সাথীর সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়ে। এর বিপরীত ভালো কাজও। একজন তরুণকে মোটিভেশন করে একজন ভালো ব্যক্তিতে রূপ দেওয়া যতটা সহজ, ঠিক তদ্রƒপ মোটিভেশন করে একজন তরুণকে সন্ত্রাসী বানানো তার চেয়ে অধিক সহজ। তলানি খুঁজলে দেখতে পারব, ওই মোটিভেশন করা ব্যক্তিটি হয়তো ‘তরুণের’ ভালো কোনো বন্ধু কিংবা অসৎ কোনো বন্ধুই বটে।
পৃথিবীতে কোনো সৎ কিংবা অসৎ কাজ ততক্ষণ সফলতার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারেনি, যতক্ষণ না ওই কাজে সঙ্গী-সাথির সাহচার্যের ছোঁয়া না স্পর্শ করেছে। উদাহরণ মিলবে ডজন ডজন, যেমনÑখুনখারাবি, ছিনতাই, লুটতরাজ, জেনা-ব্যভিচার, এমনকি ভালোবাসার প্রিয় মানুষটাকে খুঁজে পেতেও একা একা সম্ভব কখনও হয়নি, হবেও না। এটাই চিরাচরিত প্রথা ও বাস্তবতা। অন্যদিকে পরোপকারী, সত্যবাদী, আমানতদারী। এই সবকিছু তরুণরা স্বাভাবিকভাবে পালন করতে ততটা অভ্যস্ত নয়, যতটা অভ্যস্ত বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথিদের দেখে দেখে করাটা।
এ জন্যই বাংলায় একটা সত্যও বলিষ্ঠ প্রবাদ আছে: সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। তরুণরা যদি বন্ধু বা সঙ্গী-সাথির অন্ধ সাহচর্যে গা-ভাসিয়ে দেয়, তাহলে তাদেরই ভবিষ্যৎ ধ্বংসাত্মক রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। যে ধ্বংসের বিপরীতে ‘প্রাচীর’ স্থাপন করেও ঠেকানো সম্ভব হবে না।
তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বিতীয় প্রধান কারণ, ধর্ম পালনে অনীহা ভাব প্রকাশ করা। পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি ধর্মই মানুষকে একজন ‘আদর্শ মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কোনো ধর্মই অন্যায় কাজ বা প্রথাকে ন্যায় বলে চালিয়ে দেয় না। ধর্মগুরুরা তরুণদের মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে সদা সর্বদা উপহার দিয়ে থাকে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের। ধর্মের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক তরুণ যদি তার ধর্ম-কর্মে মন দিত, তাহলে সে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ তার ধর্মগ্রন্থ থেকেই খুঁজে পেত। তার হƒদমাজারে জমে থাকা সকল হতাশা আর পাপের কালিমা ধুয়ে-মুছে ছাপ হয়ে যেত। অন্যায় সকল অভিলাষ, ধীরে ধীরে পালাতে বাধ্য থাকত। হিংস তা, বর্বতা, অজ্ঞতা রূপান্তরিত হতো ভদ্রতা, নম্রতা, আর নিরহংকারীতায়। তাই তো কবি বলে থাকেন, ধর্মেতে হয় জাতির গঠন, ধর্ম নাই তো কিছুই নাই। কিন্তু আমাদের জাতির তরুণরা ধর্ম-কর্ম সবকিছু ভুলে গিয়ে সন্ন্যাসী কিংবা সাধক হওয়ার ব্যর্থ ধ্যানে পথ চলছে। যে পথের সঠিক গন্তব্য তাদের অজানাই থেকে গেছে।
তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের তৃতীয় কারণ হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি, ইন্টারনেট, ফেসবুকের অপব্যবহার। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারের পরিমাণ তরুণদের মাঝে বেশ মহামারি আকার রূপ ধারণ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে নৈতিকতাপূর্ণ জীবনযাত্রার মান দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তরুণদের অপরাধ প্রবণতা, অশ্লীলতা, চরিত্র হননকারী সকল উপায় উপকরণ মাত্রাতিরিক্ত হারে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। তথ্যপ্রযুক্তি অপব্যবহার করে অনেক তরুণই জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক নানা অসৎ কর্মকাণ্ডে। কিশোর গ্যাং, ইভটিজিং, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা কুকর্মের মধ্যে। উচ্ছৃঙ্খল এই জীবনে তারা যেন বনে বসবাস করা হিংস্র জীব-জন্তুকেও হার মানিয়ে তুলছে। মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে জীবনের দীপ্তিময় তারুণ্যকে।
তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে, এক মাদকাসক্তই যেন যথেষ্ট। তাদের লালিত সকল সোনালি স্বপ্ন, ধুলোতে মিশিয়ে দিতে মদ, জুয়া, ইয়াবা সেবনই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। মাদকাসক্ত তরুণ দেশ জাতি পরিবারের জন্য এক ভয়ংকর অভিশাপ ডেকে আনছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, অশিক্ষিত তরুণের চেয়ে শিক্ষিত তরুণদের মাদকাসক্তের সংখ্যাই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। একটাই কারণ, বেকারত্ব সমস্যা। একটা জাতির যারা কর্ণধার হবে, আগামী দিনের কাণ্ডারি হবে, তারাই যদি মাতাল হয়, তাহলে ওই জাতির ভাগ্যে চরম দুর্ভোগ প্রহর গুনছে। গাড়ির চালক মাতাল হলে, ওই গাড়ির যাত্রীদের মৃত্যু যেমন অনিবার্য, ঠিক তেমনি শিক্ষিত তরুণরা যদি মাদকাসক্ত হয় তাহলে ওই জাতির তরুণদের পাশাপাশি জাতির ধ্বংসও সুনিশ্চিত।
এসব কারণেই তারুণদের ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যৎ অবশ্যম্ভাবী। ধ্বংস থেকে বাঁচতে তরুণরা কী করতে পারে। ক. সজ্জনের সঙ্গী হওয়া, জ্ঞানীর সাহচর্য লাভ করা। আমাদের সৃষ্টিকর্তাই আমাদের উত্তম পথপরিক্রমা বাতলে দিতে আসমানি বিধান নাজিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, হে বিশ্বাসীরা! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী সাথি হও। (আল কোরআন, ৯:১১৯ ) সত্যিকার জ্ঞানী ব্যক্তি কখনও কারও কোনো ক্ষতি সাধনের অপতৎপরতা দেখায় না, বরং সর্বদা মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজ আত্মা উৎসর্গ করে। তাই জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্য তরুণদের একান্ত কাম্য। একটা প্রসিদ্ধ প্রবাদ, মুর্খ বন্ধুর চেয়ে শিক্ষিত শত্রু অনেক ভালো; খ. ধর্মীয় রীতিনীতি যথাযথ পালন করা। প্র্যাকিটিসিং মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন হিসেবে তারুণ্যের বাঁধভাঙা আবেগকে বিবেকের দাসত্বে নতজানু করা। এই ব্যাপারে আমাদের স ষ্টা খোদা তায়ালার ফরমান: ‘সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই সব মানুষ ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ব্যতীত; যারা ইমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, সত্যের দাওয়াত দিয়েছে, ধৈর্যের দাওয়াত দিয়েছে।’ (আল-কোরআন, সুরা আসর)
এ জন্য তরুণদের উচিত ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি ঝুঁকে পড়া। ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খোঁজা; গ. মাদকসহ, নেশাকৃত বস্তুসমূহ সেবন পরিহার করা। সরকারিভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ না করে যদি প্রতিরোধ করা যেত। তাহলে তরুণদের ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যৎ থেকে রেহাই দেয়া আরও সহজ হতো বলে মনে করছি। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং লটারির তীরÑএই সব নিন্দনীয় বিষয়। শয়তানি কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং এ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাক, যেন তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (আল কোরআন, ৫: ৯০)
সর্বোপরি সমাজ বিনির্মাণে তরুণদেই জেগে উঠতে হবে, পথ দেখাতে হবে জাতিকে। তরুণদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশই তরুণ। এই প্রাণোচ্ছল প্রজš§ বর্তমানে আমাদের সামাজিক সমস্যা সমাধানের এক অভিনব শক্তি। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব এবং আন্তরিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে দেশের অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে তাদেরই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তাদের পথ দেখানোর দায়িত্ব আমাদের কাঁধেই বর্তায়। আমরা যদি তাদের গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, তাহলে অভিশাপ হয়ে চেপে বসবে তারুণ্য।
তরুণদের ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যৎ ঠেকাতে, অন্যদের চেয়ে, তরুণদেরই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে। দীপ্তিময় তারুণ্য জীবনে একবার হারিয়ে গেলে, আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। আশা করি, তারা ফিরবে, তারা আসবে, তারা চলবে সত্য সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে।
শিক্ষার্থী
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়