ইলিয়াস কাঞ্চন : প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অমূল্য জীবন হারাচ্ছে মানুষ। আর গণমাধ্যমের (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া) বিশেষ একটা অংশজুড়ে প্রতিদিনই থাকে এই সড়ক দুর্ঘটনার খবর এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী হাহাকারের চিত্র। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই বলা হচ্ছে, আমাদের দেশের রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে, যে কারণে সড়কে এই অপমৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। তাহলে কি আমরা নিরাপদ সড়ক ও যাতায়াত সুরক্ষায় আন্তরিক নই? এক্ষেত্রে কী কী করণীয়, তা নিয়ে কি কেউ ভাবার নেই? প্রশ্নগুলো আমাকেও তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রশ্ন আর প্রশ্নÑএরকম প্রশ্ন গণমাধ্যম থেকে সবার। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এই সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। আমাদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে এবং রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এখনও যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা মানুষকে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছি, মানুষ সচেতনও হচ্ছে, কিন্তু কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন না আসায় এই সচেতনতার কোনো প্রভাব পড়ছে না সড়কের ওপর। কারণ আমাদের সড়কের ব্যবস্থাপনা ও সদিচ্ছার জায়গাটাতে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণে আমি ২৯ বছর ধরে নানাভাবে বলে আসছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমার পর্যবেক্ষণে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আছে সেটা হলো সদিচ্ছার অভাব। কোনো একটা মহল এই এই সদিচ্ছাকে পেছন থেকে টেনে ধরে আছে, যে কারণে সড়ক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কাজে লাগছে না।
সড়কের এই ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু বলতে চাই। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর জাতিসংঘ যে পাঁচটি পিলারের কথা বলেছে, তার মধ্যে প্রধান হলো সড়কের ব্যবস্থাপনা। আর আমার মতে, যে কোনো ব্যবস্থাপনা তখনই সঠিক দিকনির্দেশনায় রূপ নেয় যদি আন্তরিক সদিচ্ছা থাকে। আপনাকে আগে টার্গেট বা লক্ষ্য স্থির করতে হবে, তারপর সেই টার্গেটে উপনীত হতে কী কী করা লাগবে, তা ছক অনুযায়ী সাজাতে হবে, সর্বোপরি আন্তরিকতা বা সদিচ্ছা পোষণ করতে হবে। যেমন আমার স্ত্রী সড়কের অপঘাতে প্রাণ হারানোর পর আমি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এই সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিই। আমার লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষকে সড়কের অপঘাতে যেন আর প্রাণ না হারাতে হয়, সেজন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করা। আমি চিন্তা করলাম ঠিক আছে আমি তো আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারিনি। আমি তো ইলিয়াস কাঞ্চন হয়েছি এদেশের মানুষের জন্য তাদের ভালোবাসায়। তাদের প্রতি তো আমার কিছু দায়িত্ব আছে। আমার স্ত্রী একা তো মারা যাচ্ছে না। প্রতিদিন সড়কে অনেকে মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমি যদি চেষ্টা করি তাহলে আমার এই দেশের মানুষগুলোকে আমি বাঁচাতে পারব। এই টার্গেট নিয়ে যখন আমি রাস্তায় নামলাম তখন আমাকে বলা হলো, ‘আপনি কিন্তু হিরো থেকে জিরো হয়ে যাবেন।’ কিন্তু তখনও আমার মনোভাব ছিল আমি যে মানুষের ভালোবাসায় হিরো হয়েছি, সেখানে আমার কোনো কিছু হয়ে গেলে হিরো থেকে জিরো হলেও আমার কিছু যায়-আসে না। আপনারা জানেন, আমি আমার টার্গেট অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি এবং এখনও আমি পথেই আছি। কিন্তু আজও যখন দেখি সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে, তারই আলোকে আমি মনে করি আমাদের সবার আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। কারণ আমার কাছে মনে হচ্ছে সড়কের নিরাপত্তা বলয় তৈরিতে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
আমি মনে করি, যে কাজটি করবেন তা সম্পন্ন করতে কী কী প্রয়োজন এবং করণীয়, তা নিরূপণ করতে হবে। এখানে কোনো একটা বিষয়ের ব্যত্যয় হলে কাজটি যে উদ্দেশ্যে করা, সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার মতে, যে কোনো ব্যবস্থাপনায় যদি টার্গেট বা প্রত্যাশা না থাকে, তাহলে ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা দুর্বল হবে। রোড সেফটির বেলায়ও আমি এই কথাটিই বোঝাতে চাচ্ছি। লক্ষ থাকতে হবে, রোড সেফটিকে নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের যে পাঁচটি পিলার আছে, সে পাঁচটি পিলারকে ম্যানেজমেন্টের আওতায় আনতে হবে এবং পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। মোটকথা, সবকিছু ম্যানেজমেন্টের ভেতর থাকতে হবে। এখানে কোনো একটির অভাব থাকলে কিন্তু হবে না। সব সফলতা বা সুফলের পেছনে শক্তিশালী মনোভাবই অন্যতম কারণ। উদাহরণ হিসেবে আমাদের পদ্মা সেতুর কথা বলতে পারি। এই সেতু নির্মাণে বিদেশিরা যখন অর্থায়ন করবে না বলে জানিয়ে দেয়, তখন প্রধানমন্ত্রী কঠিন ও কঠোর মনোভাব ঘোষণা করেছেনÑনিজের টাকায় পদ্মা সেতু করবেন। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও শক্তিশালী মনোভাবের কারণে আমরা পদ্মা সেতু পেয়েছি। সড়কের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আমি সব পরিকল্পনায় এই মনোভাবের কথাই বোঝাতে চাচ্ছি।
কথাটি বলতে হচ্ছে, এজন্য এ পর্যন্ত যতগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা কি কোনো কাজে এসেছে? সড়কের বিশৃঙ্খলা কি দূর হয়েছে? আমি মনে করি, সত্যিকার অর্থে আমরা যদি মনে করি, আমার দেশের মানুষগুলোকে একটা নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে হবে, তাহলে এই যে সড়কে মানুষ মারা যাচ্ছে, সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, জিডিপি লস হচ্ছে এসব বিষয়কে মাথায় রেখে ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। তার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছাসহ সরকারের আন্তরিকতা। কারণ এ কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধা-বিপত্তি আসবে, সেগুলো কীভাবে ওভারকাম করা যায়, সেটাও পরিকল্পনার মধ্যে রেখেই কিন্তু এগোতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে নীতিগতভাবে সর্বপ্রথম বিশৃঙ্খলাকে দূর করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সব অপশক্তির কালো হাত। আর এটা নিয়ন্ত্রণ করা আসলে কঠিন কোনো বিষয় নয়।
সর্বশেষে বলব সড়কের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ একটা প্রেসক্রিপশন দিয়েছে। পাঁচটা পিলার দিয়েছে। প্রত্যেকটাতে কিন্তু টার্গেট অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সড়কের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে রোড সেফটি নিয়ে আমরা যারা কাজ করছি, আমরা ১১১টা সাজেশন দিয়েছি। প্রতিটি সাজেশনকে পরিকল্পনার মধ্যে ফেলে বাস্তবায়নের জন্য সাজাতে হবে এবং কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’-এর পরিপূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত করতে হবে। এই বিধিমালার জন্য আইনটি একপ্রকার অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। অথচ এমন কিছু সমস্যা আছে যে, আইন ছাড়া নিরসন করা অসম্ভব।
অনেকেই ধানের খোলায় বা গোলায় মুরগিকে ধান খেতে দেখেছেন। দেখা গেছে, ধান খাবার সময় মুরগি পা দিয়ে কী যেন সরায়। কী সরায় তা আমরা জানি না বা বোঝার চেষ্টাও করিনি। ঠিক সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে নানা পরিকল্পনা হয়, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় দেখা যায়, কী যেন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কথাটা এজন্য বলা যে, একটি আইন পাস হয়েছে, অথচ বিধিমালা করা হয়নি। এই বিধিমালার জন্য চার বছর অপেক্ষার পরও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, কবে আমরা বিধিমালা পাব। তাহলে বলতে হয়, মুরগির সেই কী যেন সরিয়ে ফেলার মতোই বিধিমালাকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। একটি নতুন আইন কার্যকর করতে বাস্তবায়নকারী সব অংশীজনকে আইনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত করতে হয়। এমনকি প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের তৈরি করতে হয়। সড়ক পরিবহন আইনের পাশাপাশি সেই বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে পুরোপুরি তৈরি করতে হবে। সবশেষে বলব, এই মুহূর্তের করণীয় হচ্ছে, যে আইন আছে, তার বিধিমালা দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিআরটিএ’কে আইন প্রয়োগের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অন্তত আইনটি সড়কে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা হলে দুর্ঘটনা আমরা অনেকাংশে রোধ করতে পারব।
পিআইডি নিবন্ধ